‘দিল্লি চলো’ ডাক আসার পরপরই মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার ওয়ারলি আদিবাসী কৃষকরা ২৭শে নভেম্বর ২০১৮ তারিখে দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। ডাহানু থেকে ভিরার স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছতে সারআর্বান ট্রেন, তারপর সেখান মুম্বই সেন্ট্রাল অবধি আরেকটি ট্রেন, অবশেষে এখান থেকে তৃতীয় আরেকটি ট্রেনে চেপে দিল্লির পথে রওনা দিলেন তাঁরা।
তাঁরা দিল্লি যাচ্ছিলেন ২৯-৩০শে নভেম্বর ১৫০-২০০টি কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ অখিল ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির আহবানে অনুষ্ঠিতব্য অভূতপূর্ব কৃষক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করতে। এই সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম হল অখিল ভারত কিষান সভা, যা ঐতিহাসিক ওয়ারলি বিদ্রোহের সময়ে কিংবদন্তী গোদুতাঈ পারুলেকারের নেতৃত্বে আদিবাসীদের সংগঠিত করেছিল, আজও আদিবাসীদের মধ্যে এই সংগঠনের ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান।
প্রচণ্ড ভিড়ে ঠাসা ট্রেনের কামরায় ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একটানা যাত্রার পর, পালঘর থেকে আগত ১০০ জনের এই দলটি অবশেষে হযরত নিজামউদ্দীন স্টেশনে এসে পৌঁছোলো। প্রতিবেদনটি এই যাত্রারই বিবরণী।

২৭ নভেম্বর বিকেলে পালঘর জেলার ডাহানু তালুকের মীনা বারসে কোম, সাখরী বনসাড দাণ্ডেকর ও অন্যান্যরা ডাহানু রোড স্টেশনে সমবেত হলেন


মীনাকে চুলে ফুল পরতে সাখরী সাহায্য করছেন । ফুলের গজরা (মালা) এবং উজ্জ্বল পরিধানে সজ্জিত ওয়ারলি আদিবাসী মহিলাদের উপস্থিতিতে ডাহানু স্টেশন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল ।


নীলম প্রকাশ রাভতে প্রায় এক সপ্তাহের জন্য বাড়ির বাইরে থাকবেন । তাঁর তিন সন্তান ইতিমধ্যেই মায়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। গত মার্চ মাসে যখন তিনি কৃষকদের লং মার্চে যোগ দিয়েছিলেন তখন তাঁর ছোটো ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সে ক্রমাগত মাকে ফোন করত । মীনা বহু বছর ধরেই কৃষক সভার সঙ্গে যুক্ত।


মুম্বই শহরতলি রেলপথের পশ্চিমাঞ্চলের ডাহানু রোড স্টেশনটি মুম্বই সেন্ট্রাল থেকে প্রায় ১৪৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি অন্যতম ব্যস্ত রেলপথ - যেটার মাধ্যমে মুম্বই এবং পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পণ্যবাহী মালগাড়িগুলি যাতায়াত করে ।

কিষান সভার কর্মীদের জমায়েত দেখে পুলিশ এসে হাজির হয়, তারা এই মিছিল এবং আনুষঙ্গিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের বিস্তারিত বিবরণ লিখে রাখে।

পালঘরের অন্যান্য তালুক থেকে আগত কৃষকরা ডাহানু স্টেশনে তাঁদের মহিলা কমরেডদের সঙ্গে মিলিত হলেন। এই পুরুষেরা আসছেন বিক্রমগড় থেকে।

দিল্লি পর্যন্ত ট্রেনযাত্রা বেশ কষ্টসাধ্য । ভিড়ে ঠাসা একটামাত্র সাধারণ কামরায় ২১ ঘণ্টা ধরে ২00 জন যাত্রী গাদাগাদি করে চলেছেন । এঁদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন পালঘরের কৃষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কর্মী।

পালঘরের ডাহানু তালুকের ধামনগাঁও গ্রাম থেকে আগত, ৪০ বছর বয়সী সুনীতা ওয়ালওয়ী , (ডানদিক থেকে প্রথম) , ২১ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একইভাবে বসে দিল্লি যাবেন । শৌচালয়ে যাওয়া মানেও মেঝের উপর গাদাগাদিভাবে কোনওমতে বসে থাকা অসংখ্য সহযাত্রীদের ডিঙিয়ে গুঁতো মেরে এগোনো । যেহেতু তাঁরা সকলেই অসংরক্ষিত কামরায় যাত্রা করছেন , শৌচালয়ে যাওয়া মানেই নিজের সিটটি হাতছাড়া করা ।


ভিড়ে ঠাসা কামরার মধ্যেই কৃষক-রাজনৈতিক কর্মীরা এই দীর্ঘ ও কষ্টকর ট্রেন যাত্রায় সময় কাটানোর জন্য প্রতিবাদী এবং বিপ্লবী গান ধরেছেন । জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য রাজা গেহলা কৃষি সংকট নিয়ে স্বরচিত গান গাইছেন।
যে সকল মধ্যবিত্ত মুম্বইকর কৃষিজীবীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে দিল্লির মিছিলে যোগ দিতে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মুম্বইয়ের যোগেশ্বরীর বাসিন্দা সঞ্জীব শামনথাল ।

রাজস্থানের মহিলা যাত্রীরা পালঘরের কৃষকদের আলোচনা ও স্লোগান সম্পর্কে বেশ কৌতূহলী। তাঁরা নিজেরাও কৃষক। রাজস্থানের বুন্দী জেলার হিন্দোলী তেহসিলের দাবালনা গ্রামের মনভরি দেবী আমাদের বলছিলেন খরা এবং জলশূন্য খালগুলির জন্য জোয়ার ও গমের ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে । রাজস্থানের কারৌলী জেলার তোড়াভীম তেহসিলের প্রেমবাঈ জানালেন জমিতে উৎপাদিত ফসলের দর কখনই চাষের খরচের (ইনপুট খরচ বাবদ) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না এবং তাঁর পরিবারকে টিকে থাকার জন্য অপরের জমিতে কৃষিশ্রমিকের কাজ করতে হয়। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদান এবং জল সংকট নিরসন হল দিল্লিতে আসা কৃষকদের প্রধান প্রধান দাবি ।


দুইদিনের ট্রেন যাত্রার ধকল মহিলা যাত্রীদের জন্য বিশেষ করে কষ্টকর কারণ মাঝেমাঝেই তাঁদের আগ্রাসী পুরুষদের জটলার মুখোমুখি হতে হয়।
সুনীতা ওয়ালওয়ির বাবা কিষান সভার সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সুনীতা নিজেও এই বছরের শুরুর দিকে নাসিক-মুম্বই লং মার্চে অংশগ্রহণ করেছিলেন । তাঁর কথায়, 'আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মিছিল জারি থাকবে।'

অবশেষে গোল্ডেন টেম্পল মেল ট্রেন যেটি মুম্বই সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ২৭শে নভেম্বর রাত ৯.২৫ মিনিটে ছেড়েছিল, সেটি , ২৮শে নভেম্বর সন্ধে ৬.৪৫ মিনিটে নিজামউদ্দীন স্টেশনে এসে পৌঁছোলো ।

ট্রেনে যখন একসঙ্গে বিশাল দল ভ্রমণ করে , তখন হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে । নিজামউদ্দীন স্টেশনের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কিষান সভার ব্যানার লাগানো হয়েছে যাতে ২৪ কোচ বিশিষ্ট এই সুদীর্ঘ ট্রেনের প্রত্যেকে সেখানে সমবেত হতে পারেন।

পালঘর থেকে আসা দলটিতে প্রায় ১০০ জন মানুষ রয়েছেন । তাঁরা নিকটবর্তী গুরুদুয়ারা শ্রী বালা সাহেব জী অবধি হেঁটে যাবেন । এখানেই নেশন ফর ফারমার্স গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাকর্মীরা কৃষকদের থাকার ব্যবস্থা এবং শিখ লঙ্গরে আহারের ব্যবস্থা করেছেন ।

নিজামউদ্দীন স্টেশন থেকে গুরুদুয়ারা অবধি ২০ মিনিটের পথে কৃষকরা দিল্লির বীভৎস যানজটের মধ্যে দিয়েই হাঁটলেন । আগামী দিনগুলিতে হয়তো দিল্লির রাস্তার সুস্বাদু খাবারগুলো খাওয়ার সুযোগ মিলবে।

কৃষকদের পাশে দেশ বা নেশন ফর ফারমারস – এই শহুরে কৃষি-বন্ধু স্বেচ্ছাকর্মীদের সংহতি দল , কিষান সভার স্বেচ্ছাকর্মী এবং গুরুদুয়ারা শ্রী বালা সাহিব জীর কর্তৃপক্ষ মহারাষ্ট্র , কর্ণাটক , অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা এবং দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলি থেকে আগত অতিথিদের জন্য কার্পেট , বিদ্যুত সংযোগ , জল এবং চলমান শৌচালয় ইত্যাদির ব্যবস্থা করে এই নির্মীয়মাণ, অসম্পূর্ণ বাড়িটিকে প্রস্তুত করেছেন । ২৯ শে নভেম্বর বিকেলে দক্ষিণ ভারত থেকে ‘দিল্লি চলো’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে আসা পাঁচ হাজারেরও অধিক মানুষের একটি বিশাল দল এই গুরুদুয়ারা থেকে নয় কিলোমিটার উত্তরে রামলীলা ময়দানে যাবে। সারাদেশ থেকে আগত কৃষকরা যে পাঁচটি পথ ধরে রামলীলা ময়দান পৌঁছাবেন তার মধ্যে এটি হল একটি । ৩০শে নভেম্বর , সবাই একসঙ্গে সংসদের দিকে মিছিল করে অগ্রসর হবেন ।
বাংলা অনুবাদ : স্মিতা খাটোর