গায়ের ক্ষতগুলি দেখাবেন বলে কষ্টেসৃষ্টে খাটিয়ায় এসে বসেছেন সুধীর কোসারে - ডান পায়ের পাতায় গভীর একটা ক্ষত; ডান উরুতে প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার লম্বা কাটা; ডান হাতের নিচের দিকে লম্বা করে চেরা যাতে সেলাই পড়েছে অনেকগুলি, আর তাছাড়া সারাগায়ে কালশিটের দাগ।
নিজের দুই কামরার ন্যাড়া অন্ধকার বাড়িতে বসে অস্বস্তি ও দৃশ্যতই যন্ত্রণায় কাতর সুধীরকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, সেই বিভীষিকা একেবারে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে। স্ত্রী, মা, ভাই পাশে বসে আছেন। বাইরে দীর্ঘ, দগ্ধ প্রতীক্ষার পর এই অঞ্চলে বহু দেরি করে আসা বৃষ্টি অবিরাম ধারায় ঝরছে।
২০২৩ সালের ২ জুলাই সন্ধ্যায় লোহার-গাডি জাতির (গাডি লোহার নামেও পরিচিত এবং রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর জাতি হিসেবে নথিভুক্ত) ভূমিহীন কৃষক সুধীর খেতে কাজ করতে করতে এক বিশাল ও হিংস্র বুনো শুয়োরের হামলার মুখে পড়েন। ছিপছিপে কিন্তু পেশিবহুল ৩০ বছর বয়সি কৃষক জানাচ্ছেন, হামলায় গুরুতর আহত হলেও ভাগ্যক্রমে বুক এবং মুখমণ্ডল বেঁচে গেছে তাঁর।
চন্দ্রপুর জেলার সাওলি তেহসিলের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় লুকিয়ে থাকা ছোট্ট গ্রাম কাওয়াথিতে সুধীরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে পারি; দিনটা ৮ জুলাইয়ের সন্ধ্যা - হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
স্মৃতিচারণ করলেন, কীভাবে তাঁর আর্তচিৎকার শুনে জমিতে কর্মরত এক ট্র্যাক্টর চালক মজুর শুয়োরটাকে ঢিল মারতে মারতে ছুটে এসেছিলেন, নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে।
মেঘলা আকাশের দিকে মুখে করে চিত হয়ে পড়ে যাওয়ার পর ভয়ার্ত চোখে দেখেছিলেন, নিশ্চিত মৃত্যুর মতো তড়িৎগতিতে তাঁর উপর নেমে আসছে জন্তুটার - সম্ভবত মাদি - দুটো পেল্লায় দাঁত। “বারবার পিছিয়ে গিয়ে গতি বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার গায়ে দাঁতদুটো গেঁথে দিচ্ছিল,” বলছেন সুধীর; পাশে হতভম্ব স্ত্রী দর্শনার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সত্যিই বেঁচে ফিরেছেন তাঁর স্বামী।
তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে পাশের ঝোপজঙ্গলে ঢুকে পড়ে জন্তুটা।


২০২৩ সালের জুলাইয়ে বুনো শুয়োরের হামলা থেকে বেঁচে ফেরা সুধীর কোসারে। সাওলি তেহসিলের কাওয়াথি গ্রামে স্ত্রী দর্শনা এবং মা শশীকলার সঙ্গে সুধীর। ডান পায়ের পাতায় একটি গভীর ক্ষত-সহ শরীরের বহু জায়গায় আঘাত রয়েছে তাঁর
সুধীর যে খেতে কাজ করছিলেন তার মাটি সেদিনের কয়েক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে ছিল। প্রায় দুই সপ্তাহ দেরির পরে সবে বীজ রোপণ শুরু হয়েছে। সুধীরের কাজ ছিল খেত লাগোয়া জঙ্গলের সীমানার বাঁধগুলি মেরামত করা। এই কাজের জন্য সেদিন ৪০০ টাকা মিলবে; জীবনধারণের জন্য এমন নানান কাজ করে থাকেন তিনি। এলাকার অন্যান্য ভূমিহীন শ্রমিকদের মতো কাজের খোঁজে দূর দেশে না গিয়ে এইসব কাজের জন্য অপেক্ষা করাটাই শ্রেয় মনে করেন তিনি।
সে রাতে সাওলি সরকারি গ্রামীণ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ৩০ কিলোমিটার দূরে গড়চিরোলি গঞ্জের জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সুধীরকে, সেখানে তাঁর ক্ষতগুলিতে সেলাই পড়ে এবং ছয় দিনের জন্য ভর্তি করে নেওয়া হয়।
কাওয়াথি চন্দ্রপুর জেলার অধীন হলেও ৭০ কিলোমিটার দূরের চন্দ্রপুর জেলা সদর থেকে পাশের জেলার গড়চিরোলি কাছে পড়ে তাঁদের। এরপর সাওলির গ্রামীণ (সরকারি) হাসপাতালে যেতে হবে তাঁকে, র্যাবিস বা ধনুষ্টংকার প্রতিষেধক র্যাবিপার ইঞ্জেকশনের পরবর্তী ডোজ এবং ক্ষতের ড্রেসিং ইত্যাদি আনুষঙ্গিক চিকিৎসার জন্য।
সুধীর যে ধরনের হামলার মুখে পড়েছেন, তা এই অঞ্চলে চাষবাস-সংক্রান্ত ঝুঁকির সংজ্ঞাটাই বদলে দিচ্ছে। দামে মাত্রাতিরিক্ত ওঠাপড়া, জলবায়ুগত অনিশ্চয়তা, এবং আরও নানা ধরনের ঝুঁকির কারণে চাষবাস এমনিতেই অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বলে ধরা হয়। কিন্তু চন্দ্রপুর, তথা ভারতের সংরক্ষিত এবং অসংরক্ষিত বহু অরণ্যভূমি-সংলগ্ন এলাকাতেই চাষ করা আক্ষরিক অর্থেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
ফসল খেয়ে যাচ্ছে বুনো জন্তুরা, আর রুজিরুটির একমাত্র উপায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঠেকাতে বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন, একের পর এক অভিনব পন্থা বার করছেন চাষিরা। পড়ুন: ‘এ এক নতুন কিসিমের খরা’
২০২২ সালের অগস্ট মাস, এবং তারও আগে থেকে সুধীরের মতো যেসব নারী, পুরুষ, চাষি, খেতমজুরেরা বাঘ, চিতাবাঘ এবং অন্যান্য বন্যজন্তুর হামলার মুখে পড়েছেন তাঁদের সঙ্গে দেখা করছেন এবং সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন এই প্রতিবেদক। এঁরা মূলত চন্দ্রপুর জেলায় অবস্থিত অভয়ারণ্য তাড়োবা-আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্পের আশপাশের জঙ্গলাকীর্ণ তেহসিলগুলির অন্তর্গত মুল, সাওলি, সিন্দেওয়াহি, ব্রহ্মপুরি, ভদ্রাবতী, ওয়ারোরা, চিমুর ইত্যাদি গ্রামে বসবাস এবং কাজকর্ম করেন। গত দুই দশকে এইসব অঞ্চলে বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে বন্যজন্তু-মানুষ সংঘর্ষ, বিশেষ করে বাঘের ক্ষেত্রে।

চন্দ্রপুর জেলার তাড়োবা-আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্প সংলগ্ন খেত, যেখানে বুনো জন্তুদের আনাগোনা এবং হামলা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার
প্রতিবেদকের সংগৃহীত জেলা বন দপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর শুধু চন্দ্রপুর জেলাতেই বাঘের হামলায় ৫৩ জন মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে ৩০ জন সাওলি আর সিন্দেওয়াহি এলাকার বাসিন্দা। পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, বাঘ-মানুষ সংঘর্ষে কুরুক্ষেত্রের রূপ নিয়েছে এই এলাকা।
আঘাত এবং মৃত্যুর পাশাপাশি তাড়োবা-আন্ধেরির বাফার জোনের ভিতর-বাইরের গ্রামগুলিতে এখন রাজত্ব করছে ভয় আর আতঙ্ক। চাষবাসের উপর এর প্রভাব এখন থেকেই দেখা দিতে শুরু করেছে - চাষিরা ক্রমশ রবি (শীতকালীন) শস্য চাষ থেকে সরে আসছেন জন্তুদের হামলার ভয়ে, এবং এটা ঘটছে হতাশা থেকেও যে চাষ করলেও বুনো শুয়োর, বা হরিণ, বা নীলগাই এসে ফসল খেয়ে যাবে; তোলার জন্য বাকি কিছুই থাকবে না।
সুধীরের সৌভাগ্য যে তাঁকে বাঘে ধরেনি, বুনো শুয়োরে ধরেছিল - হয়তো তাই বেঁচে ফিরতে পেরেছেন। পড়ুন: তারাখচিত আসমানের নিচে মাচানে রাতপাহারা চাষিদের ।
*****
২০২২ অগস্টের বৃষ্টিস্নাত এক বিকেলে অন্য মজুরদের সঙ্গে খেতে ধানের চারা বসাচ্ছিলেন ২০ বছর বয়সি ভাবিক জারকর, যখন তাঁর বাবার বন্ধু বসন্ত পিপরখেড়ের ফোন আসে।
পিপরখেড়ে জানান, কিছুক্ষণ আগে বাঘে হামলা করেছে তাঁর বাবার উপর। হামলায় প্রাণ হারান ভাবিকের বাবা ভক্তদা, তাঁর দেহ জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায় বাঘ।
ঘটনার সময় ৪৫ বছর বয়সি ভক্তদা তাঁর তিন বন্ধুর সঙ্গে জঙ্গল-লাগোয়া একটি খেতে কাজ করছিলেন; মাটিতে উবু হয়ে বসে সামান্য জিরিয়ে নিচ্ছিলেন যখন আচমকা যেন-বা শূন্য থেকে বাঘ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর উপর। পিছন থেকে লাফিয়ে পড়ে ভক্তদার ঘাড় কামড়ে ধরেছিল বাঘটি, সম্ভবত তাঁকে বসা অবস্থায় দেখে মানুষ বলে চিনতে পারেনি, অন্য ছোটো জন্তু ভেবেছিল।
“আমাদের বন্ধুকে বাঘে ঝোপের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল, আমরা কিচ্ছু করতে পারলাম না,” স্মৃতিচারণ করছেন পিপরখেড়ে। ভয়াবহ সেই ঘটনা আটকাতে না পারার অনুশোচনা এখনও কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁকে।
“আমরা প্রচুর চিৎকার করেছিলাম,” জানাচ্ছেন ঘটনার অন্য সাক্ষী খেতমজুর সঞ্জয় রাউত। “কিন্তু বিশাল বাঘটা ততক্ষণে ভক্তদাকে ধরে ফেলেছে।”
সেদিন ভক্তদার জায়গায় তাঁরা যে কেউ থাকতে পারতেন, বলছেন দুই বন্ধুই।


তাড়োবা-আন্ধেরির ভিতর এবং আশপাশে ক্রমবর্ধমান বাঘ-মানুষ সংঘর্ষের অন্যতম বলি হিরাপুর গ্রামের ৪৫ বছর বয়সি ভক্তদা জারকর। তাঁর ভয়াবহ মৃত্যুর বর্ণনা দিচ্ছেন ছেলেমেয়ে (বাঁদিকে) ভাবিক ও রাগিনী। ঘটনার সাক্ষী ছিলেন ভক্তদার বন্ধু সঞ্জয় রাউত ও বসন্ত পিপরখেড়ে। ‘আমাদের বন্ধুকে বাঘে ঝোপের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল, আমরা কিচ্ছু করতে পারলাম না,’ বলছেন পিপরখেড়ে
বাঘটি এলাকায় ঘুরছে এমন খবর ছিল, কিন্তু একেবারে নিজেদের খেতে ঢুকে পড়বে এমনটা কেউই ভাবতে পারেননি। গ্রামে বাঘের হামলায় মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ভক্তদা প্রথম - এর আগে গরু-ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত দুই দশকে সাওলি এবং আশপাশের অন্যান্য তেহসিলে বহু মানুষ মারা গেছেন।
সুধীরের গ্রামের অনতিদূরে হিরাপুর গ্রামে নিজেদের বাড়িতে বসে ভাবিক স্মৃতিচারণ করছেন, “আমি হতভম্ব হয়ে গেছিলাম।” পাশে তাঁর বোন, ১৮ বছরের রাগিনী। এমন ঘটনা ঘটতে পারে তাঁরা কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি, আর বাবার এই চরম পরিণতির ধাক্কা থেকে এখনও বেরোতে পারেননি তিনি ও তাঁর পরিবার, জানালেন ভাবিক।
সংসার এখন ভাইবোন মিলেই সামলান; পারি-র সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে তাঁদের মা লতাবাই বাড়িতে ছিলেন না। “উনি এখনও ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি,” জানালেন রাগিনী। “বাবাকে বাঘে নিয়ে গেছে, এটা আজও মেনে নিতে কষ্ট হয়,” বলছেন তিনি।
গোটা গ্রামে আতঙ্ক ছেয়ে আছে, চাষিরা জানালেন, “আজ পর্যন্ত কেউ একা একা বাড়ির বাইরে বেরোয় না।”
*****
উঁচু শালবন আর বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য আল দেওয়া ধানের খেতগুলি বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্রের মতো লাগে। চন্দ্রপুর জেলার সবচেয়ে জীববৈচিত্র-সম্পন্ন অঞ্চলগুলির অন্যতম এটা।
বাঘ সংরক্ষণের সুফল দেখা গিয়েছে যে তাড়োবা অরণ্যে, তারই দক্ষিণে অবস্থিত সাওলি আর সিন্দেওয়াহি। ২০২৩ সালে জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ সর্বেক্ষণ (National Tiger Conservation Authority/NTCA) প্রকাশিত ২০২২ স্টেটাস অফ টাইগার কো-প্রিডেটরস্ রিপোর্ট জানাচ্ছে - তাড়োবা-আন্ধেরিতে পরিগণিত বাঘের সংখ্যা ২০১৮ সালের ৯৭ থেকে বেড়ে এ বছর দাঁড়িয়েছে ১১২-তে।
![Women farmers of Hirapur still fear going to the farms. 'Even today [a year after Bhaktada’s death in a tiger attack] , no one goes out alone,' they say](/media/images/05a-20230712_105603-JH-Chandrapurs_cultiva.max-1400x1120.jpg)
![Women farmers of Hirapur still fear going to the farms. 'Even today [a year after Bhaktada’s death in a tiger attack] , no one goes out alone,' they say](/media/images/05b-20230711_162655-JH-Chandrapurs_cultiva.max-1400x1120.jpg)
এখনও খেতে যেতে ভয় পান হিরাপুরের মেয়ে চাষিরা। ‘আজ পর্যন্ত [বাঘের হামলায় ভক্তদার মৃত্যুর প্রায় এক বছর পর] কেউ একা একা বাড়ির বাইরে বেরোন না,’ বলছেন তাঁরা
মনুষ্য বসতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকা অরণ্যবহুল এই অঞ্চলের বহু বাসিন্দাই থাকেন সংরক্ষিত এলাকার বাইরে। কাজেই সংরক্ষিত এলাকা থেকে বাইরে বেরিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলিতে বাঘের আনাগোনা স্পষ্টতই বাড়ছে। বাফার জোন এবং আশপাশের অঞ্চলের ঝোপ-জঙ্গল ও চাষজমিতে বাঘের হামলার সংখ্যা বেশি, যা থেকে অনুমান করা যায় যে কিছু বাঘ অভয়ারণ্যের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে।
অধিকাংশ হামলাই ঘটেছে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে এবং বাফার জোন ও তার আশপাশের অঞ্চলে; সবচেয়ে বেশি আক্রমণ ঘটেছে জঙ্গল এলাকার ভিতর, তারপর খেতজমি এবং হালকা জঙ্গলে, এবং সবকটিই মূলত ঘটেছে একটি উত্তর-পূর্বমুখী পথরেখার আশপাশে যা অভয়ারণ্য, বাফার জোন এবং বিচ্ছিন্ন অরণ্যভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে - জানাচ্ছে তাড়োবা-আন্ধেরি অঞ্চলে ২০১৩ সালে সংঘটিত একটি সমীক্ষা ।
বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের সাম্প্রতিক জোয়ারের একটা অন্যতম কুফল বাঘ-মানুষ সংঘর্ষ, এবং এই সমস্যা এতটাই গভীর হয়ে দাঁড়িয়েছে যে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে মুম্বইয়ে রাজ্য বিধানসভার সদ্যসমাপ্ত বাদল অধিবেশনে একটি দৃষ্টি আকর্ষণ মোশনের প্রেক্ষিতে জবাবদিহি করতে হয়েছে মহারাষ্ট্রের বনমন্ত্রী সুধীর মুঙ্গান্তিওয়ারকে। তিনি জানান, একটি ‘বাঘ স্থানান্তর’ পরীক্ষার অংশ হিসেবে সম্প্রতি দুটি পূর্ণবয়স্ক বাঘকে গোন্ডিয়ার নাগজিরা ব্যাঘ্র প্রকল্পে সরানো হয়েছে, এবং আরও বেশি পরিমাণ বাঘকে তাদের বিচরণের পর্যাপ্ত জায়গা আছে এমন অরণ্যে সরানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
একই জবাবে তিনি আরও জানান যে আঘাত বা মৃত্যুর সংখ্যা, নষ্ট ফসলের পরিমাণ এবং গবাদি পশু হত্যার সংখ্যার উপর ভিত্তি করে আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধি করবে সরকার। মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ২০ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ২৫ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু ফসল নষ্ট ও গবাদি পশু মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বাড়েনি। বর্তমানে ফসল নষ্টের ক্ষতিপূরণ সর্বোচ্চ ২৫,০০০ টাকা এবং গবাদি পশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে ৫০,০০০ টাকা।
স্বল্পমেয়াদে দেখলে, অবশ্য, এই সমস্যার কোনও আশু সমাধান চোখে পড়ছে না।

বাফার জোন এবং আশপাশের অঞ্চলের ঝোপ-জঙ্গল ও খেতজমিতে বাঘের হামলার সংখ্যা বেশি, যা থেকে অনুমান করা যায় যে কিছু বাঘ তাড়োবা-আন্ধেরির বাইরে বেরিয়ে পড়েছে
তাড়োবা-আন্ধেরি অঞ্চলের (অভয়ারণ্যের বাইরে এবং বাফার জোন ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল) উপর করা পূর্ণাঙ্গ একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, “ভারতের কেন্দ্রভাগের রাজ্য মহারাষ্ট্রে অবস্থিত তাড়োবা-আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্পের আশপাশে গত দুই দশকে মানুষের উপর মাংসাশী প্রাণীর হামলা অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।”
২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সমীক্ষাটিতে “তাড়োবা-আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভিতর এবং আশপাশে মানুষের উপর বাঘ ও চিতাবাঘের হামলার মানবিক ও পরিবেশগত দিকগুলি খতিয়ে দেখা এবং বড়ো মাংসাশী প্রাণী ও মানুষের মধ্যেকার সংঘাত কমিয়ে আনতে বা প্রতিহত করতে সুপারিশ করার” প্রয়াস করা হয়েছে। মোট ১৩২টি হামলার মধ্যে বাঘ ও চিতাবাঘ হামলা হয়েছে যথাক্রমে ৭৮ শতাংশ এবং ২২ শতাংশ।
“অন্যান্য কাজকর্মের তুলনায় ছোটোখাটো অরণ্যজাত দ্রব্য সংগ্রহ করার সময়ে হামলার মুখে পড়েছেন অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ,” জানাচ্ছে সমীক্ষা। সমীক্ষা আরও দেখাচ্ছে, জঙ্গল এবং সংলগ্ন গ্রামগুলি থেকে যতদূরে বাস, হামলায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত কম। সমীক্ষার উপসংহারে বলা হয় যে তাড়োবা-আন্ধেরির আশপাশে মানুষের কার্যকলাপ আরও সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত রাখা প্রয়োজন। তাদের আরও সংযোজন, মানুষের হাতে বিকল্প জ্বালানির (যেমন জৈব গ্যাস ও সৌরশক্তি) জোগান বাড়লে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে কাঠ সংগ্রহ করার চাপও কমবে।
মাংসাশী প্রাণীদের একে অপরের এলাকা থেকে দূরে রাখার রীতি এবং মনুষ্য-ঘনবসতি এলাকায় বন্য শিকারের অপ্রতুলতা বাঘেদের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।
সাম্প্রতিক কালের ঘটনাগুলি কিন্তু দেখিয়ে দিচ্ছে পশু চরাতে বা কাঠ কাটতে জঙ্গলে যাওয়া মানুষদের পাশাপাশি খেতে কাজ করা মানুষদের উপরেও বাঘের হামলা ক্রমশ বাড়ছে। চন্দ্রপুর জেলার বেশিরভাগ জায়গাতেই বুনো জন্তু, বিশেষ করে তৃণভোজী জন্তুদের এসে ফসল খেয়ে যাওয়া চাষিদের মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু তাড়োবা-আন্ধেরি সংলগ্ন হালকা জঙ্গল ও জঙ্গল-সংলগ্ন খেতগুলিতে বাঘ ও চিতাবাঘ হামলার সংখ্যা চরম আকার নিয়েছে, যার কোনও সমাধান অন্তত অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাচ্ছে না।
এই অঞ্চল বরাবর যাত্রা করলে বুনো জন্তু তথা বাঘের হামলা বাসিন্দাদের সবচেয়ে বড়ো উদ্বেগের কারণ হিসেবে উঠে আসে। পুণে নিবাসী বন্যপ্রাণ জীববিজ্ঞানী ড. মিলিন্দ ভাবে যেমন বলছেন, দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে এই সমস্যা ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ লক্ষ্যমাত্রাকেও প্রভাবিত করবে। স্থানীয় মানুষ যদি বন্যপ্রাণের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন, যেটা এক্ষেত্রে স্বাভাবিক, তবে সংরক্ষিত অরণ্যভূমির বাইরে থাকা বা চলে আসা বন্যপ্রাণীরাও আর নিরাপদ থাকবে না।


চান্দলি বিকে গ্রামের একটি চায়ের দোকানে (বাঁদিকে) গ্রামবাসীরা। দোকান খোলে সকাল ১০টায়, সন্ধের আগেই বন্ধ হয়ে যায় বাঘ আর বুনো শুয়োর হামলার ভয়ে। এই ধরনের ঘটনাগুলি বিশেষ করে প্রভাব ফেলেছে আধা-কৃষিজীবী কুর্মর গোষ্ঠীর (ডানদিকে) মানুষদের উপর, যাঁরা দৈনিক অন্তত ২-৩টে করে গবাদি পশু খোয়াচ্ছেন
সাম্প্রতিক বিপর্যয়টা কোনও একটি বাঘের কাজ নয়, একাধিক বাঘ ভুল করে মানুষদের অন্য বন্য জন্তু ভেবে খাওয়ার জন্য শিকার করছে। এইসব হামলায় যাঁরা পরিজনকে হারান বা যাঁরা সাক্ষী থাকেন, তাঁদের জীবন কাটে অশেষ আতঙ্ক ও শোকে।
হিরাপুর থেকে ৪০ কিলোমিটার মতো দূরে সাওলি তেহসিলের চান্দলি বিকে গ্রামের বাসিনা প্রশান্ত ইয়েলাত্তিওয়ার তেমনই একজন। ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাঁর স্ত্রী স্বরূপাকে বাঘে নিয়ে যায়। গ্রামের আরও পাঁচজন মহিলা সভয়ে দেখেন তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝোপের মধ্যে তাঁকে টেনে নিয়ে চলে গেল একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘ। ঘটনাটা ঘটে সকাল ১১টা নাগাদ।
“ছয় মাস হয়ে গেল ও চলে গেছে,” ২০২৩ সালে পারি-র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানালেন ইয়েলাত্তিওয়ার। “কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল এখনও বুঝতে পারিনি।”
ইয়েলেত্তিওয়ারদের নিজেদের এক একর জমি আছে, তার সঙ্গে তাঁরা খেতমজুরিও করতেন। সেদিন স্বরূপা এবং অন্য মেয়েরা গ্রামেরই আর একজনের খেতে তুলো তুলছিলেন - মূলত ধানচাষ এলাকায় তুলো নতুন ফসল। গ্রামের উপকণ্ঠে ওই খেতজমির ভিতর স্বরূপার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে প্রায় আধ কিলোমিটার জঙ্গলের ভিতর টেনে নিয়ে যায় বাঘ। বনকর্মী ও গার্ডদের সাহায্যে কয়েকঘণ্টা পর গ্রামবাসীরা গিয়ে তাঁর ছিন্নভিন্ন দেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এই অঞ্চলে বাঘের হামলায় মৃত্যুর তালিকায় আর একটা নাম হয়ে যান তিনি।
“বাঘটাকে তাড়াতে প্রচুর আওয়াজ করতে হয়েছিল, আমরা থালি বাজাচ্ছিলাম, ঢোল বাজাচ্ছিলাম,” জানালেন বিস্তারি আল্লুরওয়ার, সেদিন দেহ উদ্ধার করতে যাওয়া এক গ্রামবাসী।
“ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলাম,” জানাচ্ছেন ইয়েলাত্তিওয়ারদের প্রতিবেশী ছয় একর খেতজমির মালিক সূর্যকান্ত মারুতি পাড়েওয়ার। ফলশ্রুতি? “গ্রামে আতঙ্ক ছেয়ে আছে,” জানাচ্ছেন তিনি।


২০২২-এর ডিসেম্বরে বাঘের হামলায় স্ত্রী স্বরূপার মৃত্যুর ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি প্রশান্ত ইয়েলাত্তিওয়ার (বাঁদিকে)। বাঁদিকে: স্বরূপার মা সায়ত্রীবাই, বৌদি নন্দতাই ইয়েলাত্তিওয়ার, এবং বোনঝি আঁচল। স্ত্রীর মৃত্যুতে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন প্রশান্ত
গোটা গ্রাম ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে; গ্রামবাসীরা দাবি করেন বন দপ্তর সমস্যাজনক বাঘগুলোকে বন্দি করুক বা মেরে ফেলুক, তাঁদের শান্তি দিক। কিন্তু সে প্রতিবাদ খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
স্বরূপার মৃত্যুর পর থেকে এখনও কাজে ফিরতে সাহস পাননি তাঁর স্বামী। গ্রামের আশপাশে এখনও একটা বাঘ ঘুরে বেড়ায়, জানাচ্ছেন তিনি।
“এক সপ্তাহ আগেই আমার খেতে একটা বাঘ বেরিয়েছে,” জানালেন ৪৯ বছর বয়সি দিদ্দি জগলু বাদ্দামওয়ার; সাত একর জমির মালিক তিনি। “তার পর থেকে আর কোনও কাজ করতে ওই খেতে যাইনি,” জুলাইয়ের শুরুর দিকে জানিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন পর ভালো বৃষ্টি হয়ে সবে বীজ রোয়া শুরু হয়েছে তখন। “ওই ঘটনার পর থেকে আর কেউ রবি চাষ করছে না।”
স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন প্রশান্ত, ২০ লক্ষ টাকা। কিন্তু তা তো আর তাঁর স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনবে না, বলছেন তিনি। এক ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে গেছেন স্বরূপা।
*****
২০২২ সালের থেকে ২০২৩ সাল কোনও অংশেই আলাদা নয় - বাঘের হামলা আর বুনো জন্তুর ফসল খেয়ে যাওয়ার ঘটনায় এখনও অতিষ্ঠ চন্দ্রপুর জেলার সুবিস্তৃত তাড়োবা-আন্ধেরি সংলগ্ন এলাকার খেতগুলি।
মাসখানেক আগে (২৫ অগস্ট ২০২৩) বাঘের হামলার সাম্প্রতিকতম বলি বছর ষাটেকের আদিবাসী কৃষকরমণী লক্ষ্মীবাই কান্নকে। তাড়োবা-আন্ধেরির সীমান্তবর্তী এলাকায় ভদ্রাবতী তেহসিলে অবস্থিত তাঁর গ্রাম তেকাডির খুবই কাছেই মোহরালি রেঞ্জ - এই সুবিশাল অরণ্যের প্রধান ফটক।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা ইরাই বাঁধের জলাধার-সংলগ্ন এলাকায় তাঁর জমিতে পুত্রবধূ সুলোচনার সঙ্গে কাজ করছিলেন তিনি। সাড়ে ৫টা নাগাদ সুলোচনা হঠাৎ দেখতে পান ঘাস-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পিছন থেকে লক্ষ্মীবাইয়ের দিকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে একটা বাঘ। চিৎকার করে শাশুড়িকে সতর্ক করতে যাবেন, তার আগেই বৃদ্ধার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ঘাড় ধরে টেনে বাঁধের জলে নেমে যায় বাঘ। প্রাণ হাতে করে পালিয়ে সুলোচনা গ্রামবাসীদের ডেকে আনেন। কয়েক ঘণ্টা পর জল থেকে উদ্ধার হয় লক্ষ্মীবাইয়ের দেহ।


প্রয়াত স্ত্রী লক্ষ্মীবাইয়ের ফ্রেমে বাঁধানো ছবির সঙ্গে কৃষক রামরাম কান্নকে (বাঁদিকে)। গত ২৫ অগস্ট ২০২৩ তারিখে তেকাডি গ্রামে বাঘের হামলায় মারা যান তিনি। তাড়োবা-আন্ধেরির সীমান্তবর্তী এলাকায় ভদ্রাবতী তেহসিলে অবস্থিত তেকাডি, কাছেই প্রখ্যাত মোহরালি রেঞ্জ
গ্রামবাসীদের ক্ষোভ এবং সম্ভাব্য বিক্ষোভ কর্মসূচির আঁচ পেয়ে তড়িঘড়ি বনদপ্তর থেকে তাঁর শেষকৃত্যের জন্য ৫০,০০০ টাকা দেওয়া হয়, আর দিন দুয়েক পর নতুন বর্ধিত পরিমাণের হিসেবে তাঁর শোকগ্রস্ত স্বামী ৭৪ বছর বয়সি রামরাম কান্নকের হাতে তুলে দেওয়া হয় ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ।
এখন তেকাডিতে রাতপাহারার দল রয়েছে, বাঘের গতিবিধিতে নজর রাখতে ক্যামেরা ফাঁদ লাগানো হয়েছে, আর আতঙ্কে কাঁপতে থাকা গ্রামে আজকাল গ্রামবাসীরা দল বেঁধে খেতে যান কাজ করতে।
একই তেহসিলে (ভদ্রাবতী) আমাদের সঙ্গে দেখা হয় ২০ বছর বয়সি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মনোজ নীলকান্ত খেরের। ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ ভোরে বুনো শুয়োরের হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তিনি।
“বাবার খেতে আগাছা মাড়াইয়ের কাজ দেখতে গেছিলাম,” বলছেন মনোজ, “শুয়োরটা পিছন থেকে এসে একেবারে দাঁত দিয়ে গেঁথে দিল।”
ভদ্রাবতী তেহসিলেরই আর এক গ্রাম পিরলিতে মামা মঙ্গের আসুতকরের বাড়িতে একটি খাটিয়ায় শুয়ে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন মনোজ। “৩০ সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু ঘটে গেল,” বলছেন তিনি।
শুয়োর তাঁর বর্তমানে ব্যান্ডেজ করা বাম উরুতে গুঁতো মারে, তারপর সেই পায়েরই উরুর নিচের পেশীতে এত জোরে কামড় বসায় যে গোটা পেশীটা খুলে বেরিয়ে আসে - ডাক্তাররা জানিয়েছেন ওই পেশী মেরামত করতে প্লাস্টিক সার্জারি লাগবে। অর্থাৎ এখন তাঁর চিকিৎসার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় হবে পরিবারের। “আমার সৌভাগ্য আমি বেঁচে ফিরেছি,” বলছেন মনোজ। আর কেউ সেদিন আহত হননি।


সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ বুনো শুয়োরের হাত থেকে বেঁচে ফিরলেও চরম ক্ষত নিয়ে এসেছেন মনোজ নীলকান্ত খেরে (বাঁদিকে)। ২০ বছর বয়সি নীলকান্ত ওয়াদগাঁও গ্রামে তাঁর বাবার খেতে তদারকি করছিলেন যখন ‘শুয়োরটা পিছন থেকে এসে একেবারে দাঁত দিয়ে গেঁথে দিল’। খেতমজুররা এখন দল বেঁধে (ডানদিকে) কাজ করেন, আর একজন সারাক্ষণ খেতে নজর রাখেন কোথাও বুনো জন্তু লুকিয়ে আছে কিনা
শক্তপোক্ত চেহারার তরুণ মনোজ, কৃষক বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁর প্রত্যন্ত গ্রাম ওয়াদগাঁওয়ে সরকারি পরিবহণ যায় না। তাই তাঁর মামা তাঁকে পিরলিতে এনে রেখেছেন যেখান থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরের ভদ্রাবতীর হাসপাতালে যাওয়া-আসা করা তুলনায় সহজতর।
স্মার্টফোনে তুলে রাখা সেদিনের তাজা ক্ষতগুলির ছবি দেখান তিনি, যা থেকে বোঝা যায় ঠিক কতটা ভয়াবহ ছিল সেই হামলা।
মানুষের মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ব তো আছেই, পাশাপাশি চাষবাসের উপরেও এইসব ঘটনার প্রবল প্রভাব পড়ছে, জানালেন চান্দলি গ্রামের বাসিন্দা সমাজকর্মী চিন্তামন বালামওয়ার, আধা-কৃষিজীবী কুর্মর জনজাতির (রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর জাতি হিসেবে নথিভুক্ত) সদস্য। “চাষিরা আজকাল রবি শস্য চাষ প্রায় করছেই না, আর খেতমজুররা খেতে যেতে ভয় পাচ্ছে,” জানালেন তিনি।
বুনো জন্তুর হামলা এবং বাঘের আনাগোনা বিশেষ করে প্রভাব ফেলেছে রবি শস্য চাষের উপর। রাতপাহারা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে বলতে গেলে, আর সন্ধের পর গুরুতর দরকারেও গ্রামের বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছেন গ্রামবাসীরা, যেটা নিয়ে আগে কোনও সমস্যাই ছিল না।
কাওয়াথি গ্রামের বর্ষীয়ান খেতমজুর এবং সুধীরের মা শশীকলাবাই খুব ভালো করেই জানেন সেই ভয়ানক দিনে মৃত্যুর কতটা কাছাকাছি চলে গেছিলেন তাঁর ছেলে।
“আজি মাঝা পোরগা ভাচলা জি,” ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মারাঠিতে বারবার করে বলে চলেন তিনি। কথার অর্থ - সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছে আমার ছেলেটা। “ওই আমাদের পরিবারের খুঁটি।” সুধীরের বাবা নেই। তিনি প্রয়াত হয়েছেন বহু বছর হল। “শুয়োর না হয়ে যদি বাঘ হত, তবে কী হত?” মায়ের মনের প্রশ্ন থামে না।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী