“পানির স্তর বাড়লেই আমাদের অন্তারাত্মা কেঁপে ওঠে,” বললেন হরেশ্বর দাস। আসামের বগরিবাড়ির মানুষ তিনি, বর্ষাকাল এলেই সারাটাক্ষণ তক্কে তক্কে থাকেন এখানকার লোকে। পাশেই পুঠিমারি নদী, পাছে সে দুকূল ছাপিয়ে ঘরদোর, ফসল-টসল সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
“বৃষ্টি নামলে জামাকাপড় বাঁধছাঁদ করে তৈরি হয়ে থাকি। গেল বারের বানে দুটো কাঁচাবাড়িই ভেঙে পড়েছিল। বাঁশ আর মাটি দিয়ে নতুন করে দেওয়াল তুলতে হল,” সংযোজন করলেন তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী দাস।
নীরদা দাসের কথায়: “[ক্ষতিগ্রস্ত] টিভিটা বস্তায় পুরে ছাদে তুলে রেখেছিলাম।” বিগত বন্যায় এর আগের টিভিটারও বারোটা বেজে গিয়েছিল।
১৬ই জুন ২০২৩-এর সেই ভয়াবহ রাত, অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। গতবছর ভেঙে পড়া বাঁধের একাংশ বালির বস্তা দিয়ে মেরামত করছিলেন গ্রামবাসীরা। দু-দুটো দিন কাটার পরেও বৃষ্টিটা ধরার কোনও নাম নিল না। কাছেপিঠের ধেপারগাঁও, মাদৈকটা, নিজ কাউরবাহা, খণ্ডিকর, বিহাপারা ও লাহাপারা গ্রামের মত বগরিবাড়ির লোকজনও তটস্থ হয়েছিলেন। বাঁধের যে অংশটা সবচাইতে কমজোর, জলের তোড়ে সেটা আবার না ভেঙে পড়ে — এই ভয়টাই কুরেকুরে খাচ্ছিল।
শেষমেশ চারদিন পর বৃষ্টিটা ধরে আসে, পানির স্তরটাও কমে যায়, হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন সবাই।
“বাঁধ ভাঙলে জলবোমার মতো লাগে। সামনে সে যা-ই পড়ুক না কেন, সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে ছাড়ে,” হরেশ্বর দাদু বুঝিয়ে বললেন। ৮৫ বছর বয়সি এই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকটি এককালে কে. বি. দেউলকুচি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে অসমিয়া পড়াতেন।
তবে ১৯৬৫ সালে এই জলবাঁধ নির্মিত হওয়ায় লাভের চাইতে লোকসানটাই যে বেশি হয়েছে, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত: “শালিজমি পুনরুজ্জীবিত করার বদলে ভরাডুবি করে ছেড়েছে।”

![His wife Sabitri (right) adds, 'The previous flood [2022] took away the two kutchha houses of ours. You see these clay walls, they are newly built; this month’s [June] incessant rain has damaged the chilly plants, spiny gourds and all other plants from our kitchen garden'](/media/images/02b-RUB09045-WR_and_PD-In_Bagribari-the_ri.max-1400x1120.jpg)
বাঁদিকে: ১২টি প্লাবনের সাক্ষী থেকেছেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক হরেশ্বর দাস, ৮৫। তাঁর কথায়, ‘বাঁধ ভাঙলে জলবোমার মতো লাগে। শালিজমি পুনরুজ্জীবিত করার বদলে সামনে সে যা-ই পড়ুক না কেন, সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে ছাড়ে।’ ডানদিকে: তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী দাস জানাচ্ছেন, ‘গত বন্যায় [২০২২] আমাদের দু-দুটো কুঁড়েঘর ভেসে গেছে। মাটির যে দেওয়ালগুলো দেখছেন, এগুলো সব নতুন করে বানানো; এ মাসের [জুন] নাছোড়বান্দা বৃষ্টিতে বাগানের লংকাগাছ, কাঁকরোল, সমস্ত কিছু নষ্ট হয়ে গেছে’


বাঁদিকে: পানির কবল থেকে বাঁচাতে জিনিসপত্র সব উঁচু জায়গায় তুলে রাখেন সাবিত্রী দিদা। বৃষ্টির ভয়ে আগে থেকে সবকিছু গোছগাছ করে তৈরি থাকতে হয় তাঁকে। ডানদিকে: বীজ রোপনের সময় হয়েছে বটে, কিন্তু বালি ঢাকা জমিনে চাষ না-মুমকিন, তাই বগরিবাড়ির একজন চাষিও কাজ করতে পারছেন না
পুঠিমারি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বগরিবাড়ি, মোটে ৫০ কিলোমিটার দূরে বয়ে চলেছে বছর বছর দুকূল ছাপানো ব্রহ্মপুত্র। বর্ষার মাসগুলোয় না জানি কত বিনিদ্ররজনী কাটান গ্রামবাসীরা, ভয় হয়, এই বুঝি হুড়মুড়িয়ে জলের স্তর বাড়তে শুরু করল। জুন, জুলাই, অগস্ট, তিন-তিনটে মাস বাকসা জেলার গাঁয়ের জোয়ান ছেলেমেয়েরা সারারাত জেগে বাঁধ পাহারা দেয়, সব্বার চোখ থাকে পানির দিকে। “হয় বানের সঙ্গে যুদ্ধ কিংবা বানের ভয়ে বেঁচে থাকা — বছরের পাঁচটা মাস এভাবেই কাটে আমাদের,” বললেন হরেশ্বর দাদু।
বগরিবাড়ির আরেক বাসিন্দা যোগমায়া দাসের কথায় স্পষ্ট হল আরও একটি বিষয়, “বিগত বহু দশক ধরে প্রায়শই দেখি যে বর্ষা নামলেই বিশেষ কয়েকটা স্থানে বাঁধ ভাঙছে।”
হয়তো এই কারণেই অতুল দাসের ছেলে হীরকজ্যোতি সদ্য সদ্য কনস্টেবল পদে আসাম পুলিশের নিরস্ত্র বিভাগে যোগ দিয়েছেন। বাঁধ নির্মাণ বা মেরামতির উপর থেকে তাঁর আস্থা উঠে গেছে।
“বাঁধটা হুনোর কোনি পোরা হাহ্ -এর [সোনার ডিম পাড়া হাঁস] মতন,” অতুল বাবু, ৫৩, জানাচ্ছেন, “যখনই ধ্বসে পড়ে, তড়িঘড়ি এসে উপস্থিত হয় রাজনৈতিক দল আর সংগঠন। ঠিকেদার বাঁধ বানায়। তারপর বান ডাকলেই আবার হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।” স্থানীয় যুবসমাজ আরও ভালোভাবে মেরামতির করার দাবি জানালেই “পুলিশ এসে হুমকি দেয়, গায়ের জোরে তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়।”
বগরিবাড়ির মাঠঘাট, ঘরবাড়ি, পথেপ্রান্তরে খোদিত আছে মানুষের দুর্দশার কাহিনি। অদূর ভবিষ্যতে আদৌ দিনবদল হবে বলে তো মনে হয় না। ২০১৫ সালে ভারতের ভূমধ্য জলপ্রণালী কর্তৃপক্ষ (আইডাব্লিউএআই) প্রকাশিত পুঠিমারি নদীর যে হাইড্রোগ্রাফিক রিপোর্টি মোতাবেক, “বাঁধ নির্মাণ ও সারাসারির চক্রটা দেখে চিরস্থায়ী বলে মনে হয়।”


বাঁদিকে: পুঠিমারি নদীর বাঁধের নিচে বালির বস্তা চাপাচ্ছেন বগরিবাড়ির মজুররা। ডানদিকে: ভাঙন রুখতে জিওব্যাগ ইস্তেমাল করে রাজ্য জলসম্পদ বিভাগ


বাঁদিকে: টাকাপয়সা ও সম্পদ কীভাবে ফালতু নষ্ট হচ্ছে, সে বিষয়ে নজর টানলেন অতুল দাস, ‘নদীবাঁধটা সোনার ডিম-পাড়া হাঁসের মতন।’ ডানদিকে: ২০২১ সালে স্থানে স্থানে বাঁধ ভেঙে গাঁ ভাসিয়ে দিয়েছিল পুঠিমারি, দূর্বলতম সেই অংশগুলি বালির বস্তা দিয়ে মজবুত করা হয়েছে
*****
২০২২ সালে তাঁদের ঘরদোর সব প্লাবিত হওয়ায় টানা আট ঘণ্টারও বেশি জানলা ধরে ঝুলেছিলেন যোগমায়া দাস ও তাঁর স্বামী শম্ভুরাম বাবু। রাত্তিরে জল বাড়তে বাড়তে কাঁধে ঠেকতেই ঝুপড়ি ছেড়ে পাশের বাড়িতে উঠে যান এই দম্পতিটি। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার (পিএমএওয়াই) আওতায় নির্মাণাধীন এই বাড়িটিও তাঁদের। পানির তোড়ে পাকাবাড়িটাও ডুবে গিয়েছিল, তখন বাঁচার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় জানলাগুলো।
“দুঃস্বপ্নের মতো ছিল,” সেই দিনটায করাল ছায়া খেলে বেড়াচ্ছিল যোগমায়া দেবীর মুখমণ্ডলে।
বন্যা-বিধ্বস্ত ভিটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ২০২২ সালের ১৬ই জুনের সেই বিভীষিকাময় রাত্তিরের কথা মনে করছিলেন বছর চল্লিশেকের যোগমায়া দেবী: “আমার মরদ [স্বামী] আমায় বারবার আশ্বস্ত করছিল যে পানি সরে যাবে, বাঁধটা ভাঙবে না। খুব ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু শেষমেশ চোখদুটো লেগে যায়। আচমকা পোকার কামড়ে ঘুম ভেঙে দেখি যে খাট-টা প্রায় ভাসছে।”
গ্রামের বাদবাকি বাসিন্দাদের মতো এই দম্পতিটিও কোচ-রাজবংশী জাতির মানুষ। ব্রহ্মপুত্রের উপনদী পুঠিমারির প্রধান তীর, অর্থাৎ উত্তুরের ধার ধরে ২০০ মিটার গেলেই তাঁদের বাড়ি।
ভয়ানক সেই রাত্রির বর্ণনা দিতে গিয়ে যোগমায়া দেবী বললেন, “আঁধারে কিচ্ছুটি ঠাহর করতে পারছিলাম না। কোনওমতে জানলার কাছে গেলাম আমরা। এর আগে ঢের বন্যা দেখেছি বটে, কিন্তু এত্ত জল বাপের জন্মে দেখিনি। টের পাচ্ছিলাম, আমায় ঘিরে পোকামাকড় আর সাপখোপ রয়েছে। আমার মরদের থেকে চোখ সরাই নি। জানলার কাঠামোটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিলাম।” বেলা ১১টা নাগাদ উদ্ধারকারী দল এসে তাঁদের বাঁচায় — অবশেষে খতম হয় ভোররাত পৌনে ৩টেয় শুরু হওয়া সেই নরকযন্ত্রণা।
‘বিগত বহু দশক ধরে প্রায়শই দেখি যে বর্ষা নামলেই বিশেষ কয়েকটা স্থানেই [পুঠিমারি নদীর] বাঁধটা ভাঙছে’
বছর বছর ঘরদোর মেরামত করিয়ে করিয়ে ফতুর হতে বসেছেন গ্রামবাসীরা। তাই এবছর প্লাবন ও অতিবৃষ্টির জোড়া ধাক্কায় ভিটেমাটি তছনছ হয়ে গেলেও বাড়িঘর সারাই করতে নারাজ তাঁরা। বাঁধের উপর অস্থায়ী তাঁবু পেতে রাত কাটাচ্ছে বেশ কয়েকটি পরিবার — হয় তাঁরা বন্যায় ঘরদোর সব খুইয়েছেন, কিংবা ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলেই জেঁকে বসছে মারাত্মক ভয়।
এই দ্বিতীয় দলে পড়ছেন ৪২ বছর বয়সি মাধবী দাস ও তাঁর স্বামী দণ্ডেশ্বর দাস, ৫৩। গেল বন্যার পর ভিটেখান সারিয়েও সেখানে শান্তিতে থাকতে পারছেন তাঁরা। “জলের স্তরটা যেই না একটু বেড়েছে, তৎক্ষণাৎ আমরা বাঁধের উপর পালিয়ে এলাম। এবার আর ঝুঁকি নিতে চাইছি না,” জানালেন মাধবী দেবী।
পানীয় জলের নিদারুণ সংকট সয়ে এতগুলো মানুষ রয়েছেন নদীবাঁধের উপর। মাধবী দেবী জানান যে প্লাবনের পর অসংখ্য নলকূপ চাপা পড়ে গেছে বালিগর্ভে। এক বালতি ফাঁকা প্লাস্টিকের বোতল দেখিয়ে আমায় বললেন, “পানিতে প্রচণ্ড আয়রন রয়েছে। নলকূপের কাছে জলটা ছেঁকে বালতি আর বোতলে ভরে বাঁধ অবধি বয়ে আনি।”
“এখানে চাষবাস করা বা ঘর বাঁধার কোনও মানেই নেই। বারবার বান ডাকে আর সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়,” অতুল বাবুর স্ত্রী নীরদা দাস বললেন, “দুবার ধরে টিভি কিনলাম জানেন? বানের জলে দুটোরই বারোটা বেজে গেল।” বারান্দায় একটা বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়েছিলেন মানুষটি।
কৃষিপ্রধান বগরিবাড়ি গাঁয়ের জনসংখ্যা ৭৩৯ (জনগণনা ২০১১)। অথচ বারংবার প্লাবনের ফলে সমীকরণটা পাল্টে গেছে। বানের পানি সরলেও রেখে যায় রাশি রাশি বালি, জমি হয়ে ওঠে চাষের অযোগ্য।


বাঁদিকে: ঘরের স্যান্ড-ফিল্টার থেকে পানি আনতে বাঁধের গা বেয়ে নামছেন মাধবী দাস। জুন ২০২৩ থেকে এভাবেই জল আনতে যাতায়াত করতে হয় তাঁকে। ডানদিকে: ফসলি মরসুমের ফাঁকে ফাঁকে চাষবাস ও মিস্ত্রির কাজ করেন দণ্ডেশ্বর বাবু (বেগুনি গেঞ্জি গায়ে), তিনি জানাচ্ছেন: ‘জলের স্তর বাড়তেই বাঁধের উপর উঠে আসি। এবার আর ঝুঁকি নিতে চাই না।’ তাঁর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন দ্বিজেন দাস
![Left: 'We bought a TV twice. Both were damaged by the floods. I have put the [second damaged] TV in a sack and put it on the roof,' says Nirada.](/media/images/07a-RUB09152_copy-WR_and_PD-In_Bagribari-t.max-1400x1120.jpg)

বাঁদিকে: ‘পরপর দুটো টিভি কিনতে হল। বন্যায় দুটোরই বারোটা বেজে গেছে। [ক্ষতিগ্রস্ত দ্বিতীয়] টিভিটা বস্তায় পুরে ঘরের টঙে তুলে রেখেছি,’ বললেন নীরদা। ডানদিকে: স্তূপীকৃত বালির তলায় চাপা পড়ে আছে মাটি, তাই বীজ রোপনের ঋতু শুরু হয়েও হতে পারছে না
*****
“আমাদের বাপ-দাদারা চাষজমির আশায় এখানে এসেছিলেন,” বললেন হরেশ্বর দাদু। ছোট্টবেলায় মা-বাবার হাত ধরে কামরূপ জেলার গুইয়া গ্রাম থেকে বগরিবাড়িতে এসে উঠেছিলেন তিনি। নদীখাতের উপর দিকে বাসা বাঁধে পরিবারটি। “এমন সবুজ-শ্যামল এলাকা, অথচ তেমন জনবসতি ছিল না। ওঁরা [বড়োরা] ঝোপঝাড় কেটে জমিন সাফ করে ইচ্ছেমতন যত খুশি জায়গার উপর চাষ শুরু করেন। আর আজ, নিজের জমি থেকেও চাষ করতে পারছি না আমরা।”
গত বছর (২০২২) বীজধান পোঁতার পর সবেমাত্র চারাগুলি অন্যত্র রোপন করার কথা ভাবছিলেন, ঠিক তক্ষুনি বান ডাকে। তাঁর ৮ বিঘা (প্রায় ২.৬ একর) জমি জলে ডুবে যায়, অন্যত্র সরানোর আগেই মাঠে পচে নষ্ট হয়ে যায় সমস্ত ধানের চারা।
“এবছরও খানিক বীজ পুঁতেছিলাম, কিন্তু পানির তোড়ে সব তছনছ হয়ে গেল। আমি আর কোনদিনও চাষ করব না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন হরেশ্বর দাদু। এবছর জুন মাসের একটানা বৃষ্টিতে ঘর-লাগোয়া বাগানটিও রক্ষা পায়নি — লংকা ও কাঁকরোল সহ সমস্ত শাকসবজির বারোটা বেজে গেছে।
অন্যান্য বহু মানুষের মতো ৫৩ বছরের সমীন্দ্র দাসের পরিবারও বাধ্য হয়ে চাষবাস ছেড়ে দিয়েছে। তাঁর কথায়: “১০ বিঘা [৩.৩ একর] শালিজমি ছিল। আজ তার চিহ্নটুকুও দেখা যায় না, পরতের পর পরত বালির তলায় চাপা পড়ে গেছে। এবার তো এমন বৃষ্টি হল যে আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনেই বাঁধ ফেটে পানি ঝরছিল। নদীর স্তর বাড়তেই ঘরদোর ছেড়ে ফের তাঁবুতে গিয়ে উঠলাম [বাঁশের খুঁটির উপর ত্রিপল ছাওয়া একটি অস্থায়ী শিবির]।”


বাঁদিকে: ‘১০ বিঘা জমি ছিল, আজ তার চিহ্নটুকুও পড়ে নেই; পুরোটাই বালিয়াড়ি হয়ে গেছে,’ বললেন সমীন্দ্র নাথ দাস। ডানদিকে: তাঁর বন্যা-বিধ্বস্ত ভিটের সামনে রাখা আছে একটি প্রথাগত বালি-কয়লার ফিল্টার। পানিতে এত আয়রন যে পরিশোধন না করে খাওয়াই যায় না


বাঁদিকে: যোগমায়া দেবীর কথায়, ‘শম্ভুরামকে বিয়ে করে এখানে আসার পর থেকে বন্যা বাদে আর কিছুই দেখিনি।’ ডানদিকে: ২০২২-এর বানে তাঁদের ধানখেত বালির গর্ভে তলিয়ে গেলে দিনমজুরির কাজ বেছে নিতে বাধ্য হন যোগমায়া দেবী ও তাঁর স্বামী শম্ভুরাম দাস
একদা ৩ বিঘা (প্রায় ১ একর) শালিজমির মালিক ছিলেন যোগমায়া দেবী ও শম্ভুরাম বাবু। মূলত ধানচাষ করতেন, আর মাঝেসাঝে সর্ষে। ২২ বছর আগে বিয়ের কথা মনে পড়ে যোগমায়া দেবীর। গুয়াহাটি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূর এই গ্রামটি যখন শস্য-শ্যামলা ছিল। আর আজ সেখানে দিগন্তবিস্তৃত মরুসম বালিয়াড়ি।
দেশগাঁ মরুভূমি বনে গেলে চাষবাসে ইতি টেনে অন্য কামকাজ ঢুঁড়তে লাগেন শম্ভুরাম বাবু। বগরিবাড়ির অধিকাংশ মানুষের মতো ইনিও দিনমজুরে পরিণত হন। আজ আশপাশের গ্রামগঞ্জে এটাসেটা করে দিন গেলে ৩৫০ টাকার মতো রোজগার করেন। “মানুষটা চাষ করতে বড্ড ভালোবাসত গো,” বললেন যোগমায়া দেবী।
তবে হরবখত কাজ মেলে না। তাই গৃহকর্মের দুনিয়ায় পা রাখতে বাধ্য হয়েছেন যোগমায়া দাস, দৈনিক ১০০-১৫০ টাকা মেলে। এককালে তিনি নিজেদের জমিনে ধানের চারা প্রতিস্থাপন করতেন। কখনও কখনও অন্যের জমিতেও ঘাম ঝরাতে যেতেন, খানিক উপরি রোজগারের আশায়। কৃষিকাজ ছাড়াও বুননের কাজে দক্ষ তিনি। রুজিরুটির একটা অতিরিক্ত উৎস স্বরূপ নিজস্ব একখান তাঁতযন্ত্রে গামুসা (গামছা) আর চাদর (অসমিয়া মহিলারা গাত্র বস্ত্র) বোনেন।
কৃষি আজ অলীক কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, দিনকে দিন তাই বেশি বেশি করে তাঁতের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এখানেও বাধ সেধেছে নিষ্ঠুর নদী। যোগমায়া দেবীর কথায়, “গতবছর পর্যন্ত আধিয়া চুক্তির [ফলনের অর্ধেক যায় মালিকের হাতে] ভিত্তিতে বুনছিলাম। কিন্তু হায়, তাঁতের কাঠামোটাই রইল কেবল। সুতোর নাটাই, ঢেরা, সব গিলে খেয়েছে বানে।”
কামধান্দায় মন্দা আর উপার্জনের অনিশ্চয়তা, দুইয়ে মিলে এমন অবস্থা হয়েছে যে ছেলের পড়াশোনা চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। ছেলে রাজীবের বয়স ১৫, কাউরবাহা নবমিলন উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির পড়ুয়া। গতবছর বন্যার ঠিক আগেই, বাঁধের নিকটে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে। রাজীবের দুটি দিদিও আছে — ধৃতিমণি ও নিতুমণি। দুই বোনেরই বিয়েথা হয়ে গেছে। ধৃতিমণি থাকেন কাটানিপাড়ায়, আর নিতুমণি কেন্দুকোনায়।
*****


বাঁদিকে: আজীবন প্লাবনের সঙ্গে লড়ে গেছেন অতুল দাস ও তাঁর স্ত্রী নীরদা দেবী। তাঁর কলাবাগান ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন অতুল বাবু, জুন ২০২৩-এর তৃতীয় সপ্তাহে, হুড়মুড়িয়ে বাঁধ টপকানো নদীর পানি তছনছ করে দিয়ে যায় এটি। কাগজি লেবু সহ আরও নানান সবজি চাষ করেছিলেন তিনি, বানের জলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবই
পুঠিমারি নদীর ঘনঘন বন্যায় দিশেহারা হয়ে গেছে অতুল দাসের পরিবার। “৩.৫ বিঘা [১.১ একর] জমির উপর কলা আর ১ বিঘার [০.৩৩ একর] উপর কাগজি লেবুর গাছ লাগিয়েছিলাম। আরেক বিঘার উপর কুমড়ো আর চালকুমড়ো ফলিয়েছিলাম। তারপর নদীর পানি বাড়তে বাড়তে সমস্ত গাছপালার বারোটা বাজিয়ে দিল,” অসহায় কণ্ঠে বলছিলেন অতুল বাবু। তবে সপ্তাহ দুই পর দুই-তৃতীয়াংশ ফসল বাঁচানো গিয়েছিল।
তাঁর মতে যাতায়াতের জন্য ঠিকমতন রাস্তাঘাট না থাকায় গ্রামবাসীদের অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বাঁধ ধ্বসে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক, তাই ফসল বেচতে বাজারে যাওয়াটা আজ অসম্ভবের সামিল।
অতুল বাবুর কথায়, “আগে আগে ফসল নিয়ে রাঙ্গিয়া আর গুয়াহাটিতে যেতাম। এমনও একটা সময় গেছে যখন রাত্তির হলে খেতের কলা আর কাগজি লেবু ভ্যানে তুলতাম। পরদিন ভোর ৫টা নাগাদ গুয়াহাটির ফ্যান্সি বাজারে পৌঁছে যেতাম, ফসল-টসল বেচে সেদিনই সকাল ৮টার মধ্যে ফিরে আসতাম ঘরে।” তবে গত বন্যার পর থেকে এটা না-মুমকিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“এছাড়াও শাকসবজি সব নৌকোয় তুলে ধূলাবাড়ি যেতাম। কিন্তু কী আর বলি! নদীবাঁধটা ২০০১ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার ভেঙে পড়েছে। ২০২২-এর বানের পর ওটা সারাই করতে পাক্কা পাঁচ মাস লেগেছিল,” বললেন তিনি।
বাঁধটা ধ্বসে পড়লে তাঁদের জীবন কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে দুঃখ করতে করতে অতুল বাবুর মা প্রভাবালা দাস জানালেন: “আমাদের সব্বাইকে খতম করে দিয়েছে এই বন্যা।”
তা সত্ত্বেও বিদায় জানাতে যখন বাঁধ বেয়ে উঠছিলাম, মুচকি হেসে অতুল বাবু বলে উঠলেন: “আগেরবারেও যখন বান ডেকেছিল তখন এসেছিলেন আপনারা। এবার একটা ভালো দিন দেখে আসুন। আমাদের নিজের খেতের শাকসবজি নিয়ে যাবেন সঙ্গে।”
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র