“ইয়ে বাতানা মুশকিল হোগা কি কৌন হিন্দু অউর কৌন মুসলমান [কে হিন্দু, কে মুসলিম, এটা বলা বেশ কঠিন]।”
মহম্মদ শাব্বির কুরেশি (৬৮) নিজের ও তাঁর প্রতিবেশী অজয় সাইনি (৫২) সম্বন্ধে ঠিক এমনটাই বলছিলেন। অযোধ্যা-নিবাসী এই দুই বন্ধু গত ৪০ বছর ধরে রামকোটের দুরাহি কুয়াঁ মহল্লায় বসত করছেন।
দিন গুজরানের দুশ্চিন্তা ভাগাভাগি করে নিবিড় সান্নিধ্যে বসবাস করে পরিবার দুটি — দরকার পড়লেই একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। “একবার কী যেন একটা কাজের সূত্রে বাইরে গেছি, হঠাৎই বাড়ি থেকে ফোন এল যে মেয়ে অসুস্থ। যতক্ষণ তড়িঘড়ি ঘরে ফিরেছি, ততক্ষণে বউয়ের কাছে জানতে পারলাম যে কুরেশিরা আমার মেয়েটাকে হাসপাতালেও নিয়ে গেছে, আবার ওষুধপত্রও কিনে দিয়েছে,” স্মৃতিচারণ করছিলেন অজয় বাবু।
পিঁদাড়ের উঠোনে বসেছিলেন দুই দোস্ত, চারিদিকে থিকথিক করছে মোষ, ছাগল আর আধা ডজন মুরগি। দুই বাড়ির বাচ্চারা এধার ওধার খেলাচ্ছলে ছোটাছুটি করতে কিংবা গপ্পে মশগুল।
সময়টা জানুয়ারি ২০২৪, মেলা ঢাকঢোল পিটিয়ে অযোধ্যার রামমন্দির উদ্বোধনের তোড়জোড় চলছে। মন্দির চত্বর থেকে দুই পড়শির দালান দু'খানি আলাদা করতে নতুন এখানে লোহার বেড়া বসেছে — জালিকাটা, ওজনদার, ডবল ব্যারিকেডওয়ালা।
আশির দশকে সাইনি বাবুর পরিবার যখন কুরেশিদের পাশের বাড়িতে এসে ওঠে, তখন তিনি নেহাতই কিশোর। বাবরি মসজিদ তখনও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়নি। মসজিদ চত্বরে রামের মূর্তি দেখতে আসা দর্শনার্থীদের ফুলের মালা বেচতেন অজয় সাইনি, মালা-পিছু একটাকা করে।
কুরেশি পরিবার আদতে ছিল কসাই, অযোধ্যা শহরের একপ্রান্তে একখানি মাংসের দোকান ছিল তাঁদের। কিন্তু ১৯৯২ সালে নাশকতার শিকার হন তাঁরা, ঘরদোর সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন ঝালাইয়ের কারবার শুরু করেন কুরেশিরা।


বাঁদিকে: ডিসেম্বর মাস, স্ত্রী গুড়িয়া সাইনির সঙ্গে আগুন পোহাতে পোহাতে গল্পগুজবে ব্যস্ত অজয় সাইনি (শ্যাওলারঙা জ্যাকেট গায়ে, চেয়ারে বসে)। সাইনি ও কুরেশি পরিবারের একটাই উঠোন। ছবিতে জামাল, আব্দুল ওয়াহিদ ও শাব্বির কুরেশিও রয়েছেন, সঙ্গে রয়েছে সাইনি বাড়ির ছোটোমেয়ে সোনালী (লাল সোয়েটার গায়ে)। ডানদিকে: কুরেশি সাহেব ও তাঁর স্ত্রী, নিজেদের নাতিনাতনি ও সাইনি পরিবারের সন্তান-সন্ততি-সহ
অজয় বাবু ও কুরেশি সাহেবকে কেন্দ্র করে পাড়ার নানা বয়সি বাচ্চারা খেলায় মত্ত, তাদের দিকে ইঙ্গিত করে মহম্মদ শাব্বির কুরেশি বললেন, “বাচ্চাগুলোর দিকে তাকান...ওরা হিন্দু...আমরা মুসলিম। ওরা সব্বাই ভাই-বোন। অব আপ হমারে রেহেন সেহেন সে পাতা কিজিয়ে কি ইয়াহাঁ কৌন ক্যায়া হ্যায়। হম এক দুসরে কে সাথ ভেদভাও নহিঁ করতে [আমাদের দিনান্ত জীবনের দিকে তাকালে আপনি ধরতেই পারবেন না কে কোন মজহবের। আমরা নিজেদের ভিতর ভেদাভেদ করি না]।” তাঁর কথায় সায় দিয়ে অজয় বাবুর স্ত্রী গুড়িয়া সাইনি বলে উঠলেন, “ওরা অন্য ধর্মের বটে, তবে আমাদের তাতে কিছুই যায় আসে না।”
এক দশক আগে কুরেশিদের একমাত্র কন্যাসন্তান নূরজাহানের নিকাহ হয়েছিল, তখন “অতিথিদের স্বাগত জানানো থেকে তাঁদের খাতিরদারি, অনুষ্ঠানের সমস্ত কাজে আমরা ভাগ নিয়েছিলাম। গেরস্থ মানুষ হিসেবে আমাদের ইজ্জত সমান সমান। একে অপরের জন্য যে হরবখত তৈরি আছি, এটা আমরা খুব ভালো জানি।”
যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে রামমন্দির চোখে পড়ে, তাই দেখতে দেখতেই কথোপকথন সেদিকেই মোড় নিল। নির্মাণকর্ম এখনও চলছে, অথচ এরই মধ্যে দৈত্যাকার কলেবর বাগিয়ে বসেছে সে দেউল, গগনভেদী তার চূড়া, চারধারে মস্ত সব বড়ো বড়ো ক্রেন-যন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে, শীতের কুয়াশার আগাগোড়া আবছা।
কুরেশিদের অনাড়ম্বর ইট-সুরকির দালানটার কয়েক হাত তফাতেই থম্ মেরে আছে রামমন্দির। সেদিকে আঙুল তুলে কুরেশি সাহেব জানালেন, “উওহ্ মসজিদ থি, ওয়াহাঁ জব্ মাঘরিব কে ওখত্ আজান হোতি থি তোহ্ মেরে ঘর মেঁ চিরাগ জলতা থা [ওখানে মসজিদ ছিল, মাগরিবের আজান শুরু হলে ঘরে সাঁঝবাতি জ্বালতাম আমরা]।” বাবরি ধ্বংসের আগের স্মৃতি উঠে এল তাঁর কথায়।
তবে জানুয়ারি ২০২৪-এর গোড়ায়, কেবল স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আজানধ্বনিই যে তাঁকে তাড়া করে ফিরছিল, তা কিন্তু মোটেই নয়।
“আমাদের ইত্তেলা পাঠানো হয়েছে যে রামমন্দির চত্বর লাগোয়া যত ঘরবাড়ি রয়েছে, সব ভেঙে ফেলা হবে। এপ্রিল-মে [২০২৩] নাগাদ ভূমি রাজস্ব বিভাগের জেলা আধিকারিকের দল এ অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সমস্ত বাড়ি জরিপ করে গেছেন,” এই প্রতিবেদনের লেখককে জানিয়েছিলেন অজয় সাইনি। যেহেতু মন্দির চত্বর ও জোড়া-ব্যারিকেডের এক্কেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সাইনি ও কুরেশিদের বাড়িদুটো।
গুড়িয়া দেবী যোগ করলেন, “বাড়ি ঘেঁষে এত্তবড় একখান মন্দির উঠেছে, চারদিকে এত উন্নয়ন হচ্ছে, এতে আমরা খুবই খুশি। তবে এসবে [বাস্তুচ্যুতি] আমাদের কোনও লাভ হবে না। অয়োধ্যা কা কায়াপলট্ হো রাহা হ্যায়, পর্ হম হি লোগো কো পলট্ কে [আমাদের ভাগিয়ে দিয়ে ওরা অযোধ্যা বদলাচ্ছে]।”
সেখান থেকে খানিক দূরে, ইতিমধ্যেই ভিটেমাটি সব হারিয়ে অস্থায়ী শিবিরে মাথা গুঁজতে বাধ্য হয়েছেন জ্ঞানমতী যাদব। মাটির কুঁড়েঘর, দেওয়ালময় গোবর লেপা, চারধারে খড়কুটো ভর্তি, বলপূর্বক স্থানান্তরের পর কোনওমতে নিজের পরিবারটা ধরে রেখেছেন এই বিধবা মানুষটি, তাঁর জবানে, “আমরা কোনওদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি যে আমাদের ভিটেহারা করে তবেই রাম তাঁর মন্দির পাবেন।” দুধ বেচে পেট চালায় যাদব পরিবার।


বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন জ্ঞানমতী যাদব (বাঁদিকে), কাছেই রামমন্দির। জ্ঞানমতী দেবীর পরিবার (ডানদিকে)। ছেলে রাজন (লাল-নীল গেঞ্জি পরিহিত) বসে আছেন একটি চেয়ারে
জ্ঞানমতী দেবীর ছ’কামরার পাকাবাড়িটা ছিল অহিরানা মহল্লায়, রামমন্দিরের প্রধান দেউড়ির ঠিক পাশেই। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সেটি। তাঁর বড়োছেলে রাজন জানাচ্ছেন, “ব্যাটারা দিব্যি বুলডোজার এনে আমাদের ঘরদোর সব পিষে দিল। বাড়ির খাজনা আর কারেন্টের রশিদের মতো যাবতীয় নথিপত্র দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু অফিসার বাবুরা বললেন যে ওসবের কোনও মূল্যই নাকি নেই।” সে রাতে চার-চারটে শিশু ও অতিবৃদ্ধ শ্বশুরমশাই সমেত পুরো পরিবারটি খোলা আকাশের নিচে হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় পড়েছিল, ছ’টা গরুও ছিল তাঁদের সঙ্গে। “বাড়ির একটা কুটোও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে দেয়নি,” রাজন যাদব বললেন। তারপর, দু-দু’বার স্থানান্তরের শেষে ত্রিপলের এই তাঁবুর তলায় মাথা গোঁজে এই অসহায় পরিবারটি।
“এটা আমার স্বামীর পারিবারিক ভিটে ছিল। উনি, ওঁর ভাইবোন, এখানেই সক্কলের জন্ম, সে আজ পাঁচ দশকেরও আগের কথা। অথচ আমরা একটা ফুটোকড়িও ক্ষতিপূরণ পেলাম না, কারণ বাবুরা এটা নাজুল [খাস] জমি বলে দাগিয়ে দিয়েছেন, যদিও মালিকানার সমস্ত কাগজপত্র আমাদের আছে,” জ্ঞানমতী যাদব বললেন।
কুরেশি সাহেব ও তাঁর ছেলেদের বক্তব্য, যথাযথ ক্ষতিপূরণ পেলে তাঁরা অযোধ্যা শহরেই অন্যত্র কোনও জমি দেখে উঠে যাবেন, তবে খুশি মনে নয়। শাব্বির সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্রদের মধ্যে একজন, জামাল কুরেশি বললেন, “এখানে আমাদের সব্বাই চেনে-জানে; কাছের রিশতেদার আছে অনেকে। এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে যদি [মুসলিম অধ্যুষিত] ফৈজাবাদে চলে যাই, তাহলে আর পাঁচটা ইনসানের মতোই হয়ে যাব। অযোধ্যাবাসী আর থাকব না।”
এ বিষয়ে অজয় বাবুও একমত, “আমাদের ধম্মকম্ম সব এই মাটির টানে বাঁধা। আমাদের যদি ভাগিয়ে দেওয়া হয়, ধরুন ১৫ কিলোমিটার দূরে, তাহলে আমাদের মজহব আর কাম-ধান্দা, দুটোই খোওয়া যাবে।”
এই যে তিনি ভিটেমাটি ছেড়ে দুরে কোথাও যেতে নারাজ, সেটা তাঁর পেশার তাগিদেও বটে। অজয় বাবুর কথায়, “রোজরোজ ২০ মিনিট সাইকেল চালিয়ে নয়াঘাটের কাছে নাগেশ্বরনাথ মন্দিরে ফুল বেচতে যাই। পর্যটকদের ভিড় মোতাবেক দিন গেলে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা কামাই। সংসার চালানোর এটাই আমার একমাত্র উপায়।” এই ছকটা এক ইঞ্চিও যদি বদলায়, তার মানে “যাতায়াতে সময়টাও বাড়বে, সঙ্গে উপরি খরচাপাতিও,” জানালেন তিনি।
জামাল কুরেশির কথায়, “আমাদের খিড়কি উঠোনে এরকম একখান ঝাঁচকচকে মন্দির খাড়া হয়েছে, আমরা অবশ্যই গর্বিত। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেটা বিশ্বাসের আধারে মঞ্জুর করেছে, তার বিরুদ্ধে হাঁটার কোনও মানেই নেই।”
“কিন্তু,” যোগ করলেন তিনি, “এখানে আমাদের আর থাকতে দেবে না। আমাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।”


বাঁদিকে: মন্দিরের নির্মাণ মজদুররা দুরাহি কুয়াঁ পাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, পিছনে সেই ডবল-ব্যারিকেডেড বেড়া। ডানদিকে: রামমন্দিরের দেউড়ির সামনে কাতারে কাতারে লাইন দিয়েছে ভক্তরা
পাড়াটা একখান আধা-সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে, বাড়ির চারপাশে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর (সিআরপিএফ) সশস্ত্র জওয়ানরা ঘোরাফেরা করছে, ভিটের কাছেই দেউলের পিছনের দিকে তৈরি হয়েছে নজরদারি-মিনার (ওয়াচটাওয়ার) — এরই মধ্যে এসবের চাপ টের পাচ্ছে পরিবার দুটি। “ফি মাসে হরেক সংস্থা থেকে চারবার করে এসে এসে বাসিন্দাদের খানাতল্লাশি করে যায়। বাড়িতে ধরুন কোনও মেহমান বা আত্মীয়স্বজন রাত কাটাবে, তাদের খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু থানায় গিয়ে জানিয়ে আসাটা বাধ্যতামূলক,” গুড়িয়া দেবী জানাচ্ছেন।
অহিরানা গল্লি (গলি) সহ মন্দির সংলগ্ন বেশ কিছু রাস্তায় গাড়িঘোড়া চাপা মানা। ফলত হনুমান গড়ির মতো মধ্য অযোধ্যার কোনও অঞ্চলে পৌঁছতে হলে অহেতুক ঘুরে ঘুরে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে বাধ্য হন স্থানীয় বাসিন্দারা।
২২ জানুয়ারি ২০২৪, মহাসমারোহে চলে রাম মন্দির উদ্বোধন, দুরাহি কুয়াঁয় কুরেশি ও সাইনি পরিবারের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই কাতারে কাতারে এসে উপস্থিত হন রাজনৈতিক নেতামন্ত্রী ও তারকাদের মতো তাবড় তাবড় ভিআইপিরা।
*****
সোমবার, ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকার তার ২০২৪-২৫ সালের বাজেট পেশ করে — বলাই বাহুল্য সেটা কৌশল্যাসূত রামের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করেছেন, “এই বাজেটের চিন্তা, অঙ্গীকার ও প্রতিটি শব্দে ভগবান শ্রী রাম রয়েছেন।” পর্যটন উন্নয়নে ১৫০ কোটি ও আন্তর্জাতিক রামায়ণ ও বৈদিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ১০ কোটি সমেত ১,৫০০ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে অযোধ্যার পরিকাঠামোগত উন্নতির খাতে।
মূল দেবালয়টি ২.৭ একরের , তবে রামমন্দিরের গোটা চত্বরটা নাকি ৭০ একরেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। পুরো প্রকল্পটাই শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র অছি পর্ষদের (এসআরজেটিকেটি) তহবিলে পুষ্ট। এই অছি পর্ষদটি সেই গুটিকয়েক ভাগ্যবান সংগঠনের মধ্যে পড়ছে যারা বিদেশী অবদান নিয়ন্ত্রণ আইনের (ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন অ্যাক্ট বা এফসিআরএ) আওতায় নিবন্ধিত। এর ফলে বিদেশী নাগরিকরা বিনা বাধায় অনুদান দিতে পারবেন। কোনও ভারতীয় নাগরিক যদি উপরোক্ত অছি পর্ষদে দান করেন, সেটা তাঁদের কর থেকে মকুব হবে।
ওদিকে অযোধ্যার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বদান্যতা’ ছাপিয়ে গেছে রাজ্য সরকারের বাজেটকে। ইতিমধ্যেই ১১,১০০ কোটি টাকার ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া রেলস্টেশন পুনর্গঠনে ২৪০ কোটি ও নতুন বিমানবন্দরের জন্য ১,৪৫০ কোটি টাকা তো আছেই।
দেউল উদ্বোধনের পর আরও উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উত্তরপ্রদেশ সরকারের মূখ্য সচিব (পর্যটন) মুকেশ মেশরাম জানাচ্ছেন, “মন্দির খোলার পর প্রতিদিন আনুমানিক ৩ লাখেরও অধিক পর্যটকের সাক্ষী হতে চলেছে অযোধ্যা নগরী।”
এতটা বিশাল সংখ্যক অতিরিক্ত দর্শনার্থীর জন্য প্রস্তুতি না নিলেই নয়, তাই শহর জুড়ে পুরোনো ঘরবাড়ি ও সাবেকি দোস্তির বুক চিরে বাস্তবায়িত হবে পরিকাঠামো সম্প্রসারণ প্রকল্প।


বাঁদিকে: একসঙ্গে জড়ো হয়েছে দু’টি পরিবার — কুরেশি ও সাইনি। আনমোল (এক্কেবারে ডানদিকে), সোনালী (লাল জাম্পার গায়ে), আব্দুল সাহেব (সাদা জামায়), গুড়িয়া দেবী (ববি প্রিন্ট শাড়িতে) তথা অন্যান্যরা। ডানদিকে: জ্ঞানমতী যাদবের ননদ চন্দা। রামের ছবিটা তাঁর ঠিক পিছনেই ঝুলছে


বাঁদিকে: ‘রাম পথ’ নামক প্রধান সড়কটি চওড়া করতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে ইমারতগুলি। ডানদিকে: নতুন করে সাজানো অযোধ্যার রেলস্টেশন। এ সপ্তাহের রাজ্য বাজেটে পর্যটন উন্নয়নে ১৫০ কোটি এবং আন্তর্জাতিক রামায়ণ ও বৈদিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ১০ কোটি সমেত ১,৫০০ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে অযোধ্যার পরিকাঠামোগত উন্নতির খাতে
কুরেশি সাহেবের ছেলে জামাল বললেন, “গলির বাঁকে যে মুসলমান পরিবারটি থাকে, ওঁরা আমাদের রিশতেদার, ওঁরা ইতিমধ্যেই ভরপাই পেয়ে গেছেন। ওঁদের বাড়িটা মন্দিরের বেড়া ছুঁয়েছিল, তাই খানিকটা ভেঙে ফেলা হয়েছে।” তিনি আরও জানালেন যে রামমন্দিরের ৭০ একর চত্বর ঘিরে ৫০টি মুসলিম পরিবার সমেত প্রায় ২০০টি পরিবারের বাস — তাঁদের প্রত্যেকের জমিজমার উপর এসআরজেটিকেটির নজর পড়েছে, তাই আজ নয়ত কাল উচ্ছেদ হল বলে।
ভিএইচপির নেতা শরদ শর্মা তো বলেই খালাস যে, “মন্দিরের পরিধির মধ্যে যে দালানগুলো পড়ছিল সেগুলো অছি পর্ষদ কিনে নিয়েছে, লোকজন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েও গেছে। বাড়তি অধিগ্রহণের কোনও পরিকল্পনা নেই,” অথচ স্থানীয় মানুষজনের বক্তব্য যে রামমন্দিরের আশপাশে যত জমি রয়েছে, সে বাস্তুভিটেই হোক বা ফকিরে রামমন্দির ও বদর মসজিদের মতো ধর্মস্থল — সব জোরজবরদস্তি ছিনিয়ে নিচ্ছে অছি পর্ষদ।
ওদিকে, ইতিমধ্যেই বাস্তুচ্যুত যাদব পরিবার তাঁদের ঝুপড়ির প্রবেশদ্বারে রামের একখান ছবি টাঙিয়ে রেখেছে। “পোস্টারটা না রাখলে ওরা আমাদের এখানেও টিকতে দেবে না,” রাজন বাবু বললেন। উচ্ছেদের পর থেকে বড্ড হেনস্থা হতে হচ্ছিল, তাই ২১ বছরের এই যুবকটি তাঁর কুস্তি প্রশিক্ষণের মাঝপথে ইতি টেনে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। “প্রত্যেক সপ্তাহে অফিসের বাবুরা আর অজানা-অচেনা সব লোক এসে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, যে জমিটুকুর উপর আমরা কুঁড়েঘরটা বানিয়েছি সেটা খালি করতে হবে। এ জমিটার মালিক আমরাই, অথচ কোনও রকমের পাকাবাড়ি তোলার অনুমতি পাচ্ছি না,” পারিকে জানিয়েছিলেন তিনি।
*****
“আমার ঘরদোর সব দাউদাউ করে জ্বলছিল। অবাধ লুটপাট চলছে। আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে [উন্মত্ত দাঙ্গাবাজের দল],” ১৯৯২ সালে ৬ই ডিসেম্বর ও তার পরের সেই শিউরে ওঠা ঘটনার কথা বলছিলেন মহম্মদ শাব্বির কুরেশি, সেই যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে অযোধ্যার মুসলিমদের উপর চড়াও হয়েছিল হিন্দু বাহিনী।
তারপর একে একে কেটে গেছে তিরিশটা বছর, তবু আজও তাঁর মনে আছে, “এয়সে মাহৌল মেঁ হমকো ছুপা লিয়া গয়া অউর উসকে বাদ বাইজ্জত হমকো রাখা। ইয়েহ্ বাত, মরতে দম্ তক্ ভূলা নহিঁ পায়েঙ্গে, দিল্ সে [সে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আমার মহল্লার লোকজন আমায় লুকিয়ে রেখেছিলেন, যে কী বলব! এটা আমি ইন্তেকাল অব্দি মনে রাখব]।”
হিন্দু অধ্যুষিত দুরাহি কুয়াঁ পাড়ায় কুরেশি পরিবার সহ হাতে-গোনা কয়েকজন মুসলিম থাকেন। কুরেশি সাহেবের জবানে: “কক্ষনও ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আসেনি। এটা আমার বাপ-দাদার ভিটে। কত প্রজন্ম ধরে যে এখানে রয়েছি, তা জানি না। এখানকার হিন্দুদের মতো আমিও স্থানীয় বাসিন্দা।” পেছনের উঠোনে একখানা ধাতব খাটিয়ার উপর বসেছিলেন মানুষটি। বাড়ির কর্তা তিনিই, পরিবারটা নেহাত ছোটো নয় — নিজের আট ছেলে ও তাঁদের বউ-বাচ্চা তো আছেই, উপরন্তু কুরেশি সাহেবের দুই ভাই তাঁদের নিজের নিজের পরিবার নিয়ে থাকেন এই হাভেলিতেই। পরিবারের যে ১৮ জন সদস্য এখানে রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককেই আশ্রয় দিয়েছিলেন পড়শিরা।
গুড়িয়া সাইনি জানাচ্ছেন, “ওঁরাও তো আমাদের বাড়ির লোক, সুখেদুঃখে বরাবর আমাদের পাশে থেকেছেন। হিন্দু হয়ে যদি বিপদে-আপদে পাশে না দাঁড়াই, তাহলে অমন হিন্দুয়ানি দিয়ে হবেটা কী শুনি?”
“এটা অযোধ্যা, আপনি এখানকার হিন্দু বা মুসলিমদের বুঝবেন না। এখানকার ইনসান কতটা গভীরভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, সেটা বোঝার সাধ্যি আপনার নেই।”


বাঁদিকে: গুড়িয়া সাইনির কথায়, ‘ওঁরা তো আমাদেরই বাড়ির লোক, সুখেদুঃখে বরাবর আমাদের পাশে থেকেছেন।’ ডানদিকে: সাইনি বাড়ির ছোটোমেয়ে আনমোলের সঙ্গে শাব্বির সাহেবের নাতি-নাতনিরা


বাঁদিকে: পারিবারিক ঝালাইয়ের দোকান নিউ স্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসে শাব্বির কুরেশি, সঙ্গে দুই ছেলে আব্দুল ওয়াহিদ ও জামাল। শুরুতে এখানে কেবল লোহার খাটিয়া বানানো হত, আর আজ রাম জন্মভূমি মন্দিরের ভিতর নজরদারি-মিনার ও ধাতব ব্যারিকেডও বানাচ্ছেন কুরেশিরা। ডানদিকে: বাঁদিকে সাইনিদের দোকান, এক্কেবারে ডানদিকেরটা কুরেশি পরিবারের
হাভেলি পুড়ে খাক্ হয়ে যাওয়ার পর, একফালি জমিনের উপর ঘরের খানিক খানিক অংশ আবার করে গড়ে তোলেন কুরেশিরা। আজ উন্মুক্ত খিড়কি-উঠোন ঘিরে তিনটে আলাদা আলাদা দালান মিলিয়ে মোট ৬০ জন সদস্যের বাস এ ঠিকানায়।
কুরেশি সাহেবের মেজছেলে আব্দুল ওয়াহিদ (৪৫) ও চতুর্থ সন্তান জামাল (৩৪) মিলে একটি ঝালাইয়ের কারবার চালান। সেই সুবাদে সামনের সারিতে বসে নয়া রামমন্দির নির্মাণ দেখতে পাচ্ছেন। “১৫ বছর ধরে মন্দিরের অন্দরমহলে কামকাজ করছি, চৌহদ্দি ঘিরে ১৩টা ওয়াচ টাওয়ার আর ২৩টা বেড়-সহ হরেক কিসিমের ওয়েল্ডিং করেছি,” জামাল কুরেশি জানালেন। আরএসএস, ভিএইচপি সমেত সমস্ত হিন্দু দেবালয়ের সঙ্গেই কাজ করেন এই দুই ভাই, আপাতত আরএসএসের কার্যালয়ের ভিতর একখান ওয়াচটাওয়ার খাড়া করছেন তাঁরা। জামাল সাহেবের কথায়: “ইয়েহি তো অয়োধ্যা হ্যায় [এইটাই তো অযোধ্যা]! হিন্দু আর মুসলমান একে অপরের সঙ্গে থাকে, শান্তিতে কামধান্দা করে।”
তাঁদের দোকানটি বাড়ির সামনের দিকে, নাম ‘নিউ স্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং’। তবে কুরেশিদের মতো মুসলিম পরিবাররাই যে এই দক্ষিণপন্থী হিন্দু সংগঠনের অনুগামীদের নিশানা হন, সেটা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। “বহিরাগত লোকজন এসে খামোকা কলকাঠি নেড়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে বলেই ঝুটঝামেলা বাধে,” জানালেন জামাল কুরেশি।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যে ঠিক কতখানি ভয়াবহ, তা এখানকার পরিবারগুলি হাড়ে হাড়ে জানে — বিশেষ করে নির্বাচনের বছরে। “এধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতি বহুবার দেখেছি। আমরা জানি, এগুলো কেবল রাজনৈতিক মুনাফার জন্যই করা হয়। এসব দিল্লি আর লখনউয়ের কুর্সি দখলের খেল। এতে আমাদের বন্ধনের কোনও ক্ষতি হবে না,” জোরগলায় বললেন কুরেশি সাহেব।
অজয় সাইনি ভালো করেই জানেন যে হিংস্র জনতার সামনে পড়লে তাঁর হিন্দু পরিচয় তাঁকে সাময়িকভাবে হলেও রক্ষা করতে পারবে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে, যখন কুরেশিদের দালানবাড়ি ছারখার হওয়া সত্ত্বেও সাইনিদের গায়ে একটা আঁচড়ও পড়েনি। “প্রতিবেশীর ঘরে কেউ হামলা করলে মুসিবতটা আমাদের ঘাড়েও এসে পড়ে। ও বাড়িতে আগুন লাগলে হাওয়ায় হাওয়ায় সে আঙার আমার বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়বে,” আর সেরকম হলে, “বাড়তি আরও চার বালতি পানি ঢেলে সে আগুন নিভিয়ে দেব৷ আমরা যে একে অপরের পাশে আছি, এটুকু মনেপ্রাণে জানি,” সোজাসাপ্টা ভাষায় কুরেশি পরিবারের সঙ্গে তাঁদের আন্তরিক সংযোগের কথা তুলে ধরলেন অজয় বাবু।
“অফুরন্ত ভালোবাসা আর স্নেহ নিয়ে একসঙ্গে বেঁচে আছি,” স্বামীর কথায় সায় দিয়ে শেষ করলেন গুড়িয়া সাইনি।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র