“প্রথম বাঁদিকটা নিন। আরেকটু গিয়েই দেখবেন একটা কালো খাম্বায় ফৌজির ছবি আটকানো আছে। ওটাই ওঁর বাড়ি।” সামনেই বাঁক নেওয়া রাস্তাটার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন রামগড় সর্দারনের এক প্রবীণ সাইকেল মিস্ত্রি। গাঁয়ের মানুষের কাছে অজয় কুমারের পরিচয় ফৌজি কিংবা শহীদ বলেই।

ভারত সরকারের চোখে অজয় কুমার অবশ্য দুটোর একটাও নন।

২৩ বছরের অজয় যে তাঁর দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে এ মুলুকের সীমান্ত রক্ষা করেছেন জম্মু ও কাশ্মীরের জঙ্গি-দমন যুদ্ধে, তাতে কিস্যুটি যায় আসে না। মা-বাবা জাতিতে দলিত, ভূমিহীন, বৃদ্ধ — ছেলে মারা যাওয়ায় না জুটেছে পেনশন, না শহীদের তকমা। এক্স-সার্ভিসমেন কন্ট্রিবিউটারি হেল্থ স্কিমের আওতায় তাঁরা কোনওরকমের সুযোগ সুবিধে পাবেন না, নিদেনপক্ষে ক্যান্টিন স্টোর্স বিভাগের ছাড়টুকুও নয়। কারণ সরকারি নথি বলছে, অজয় কুমার না ছিলেন সেনা, না হয়েছেন তিনি শহীদ।

তিনি যে কেবলই এক অগ্নিবীর ছিলেন।

লুধিয়ানা জেলার এই গ্রাম অবশ্য সেসব সরকারি নথিপত্তরের কোনও তোয়াক্কা করে না। জিটি রোড ধরে রামগড় সর্দারন ৪৫ মিনিটের গাড়িপথ, দুধারে সর্ষেফুলের সমাহার। এখানকার পাঁচিলে পাঁচিলে আঁকা আছে এক আলাদা রেকর্ড। প্রতিটা দেওয়াল বহন করছে অজয় কুমারের শাহাদাত। চারিদিকে দেখবেন হোর্ডিংয়ে ছাপা জলপাই পোশাকে শহীদ অজয়ের সুকুমার চেহারা, শহীদ ভগৎ সিংহের সঙ্গে একই সারিতে তাঁর অধিষ্ঠান — যোগসূত্র আদতে খুবই সোজা। আজ ন'দশক আগেকার কথা, কমরেডদের সঙ্গে ফাঁসিকাঠে চড়েছিলেন ভগৎ সিং, তারপর না জানি কত সরকার এল গেল, অথচ শহীদের তকমাটুকু তাঁকে কেউ দিল না।

গাঁয়ের একটি হোর্ডিংয়ে লেখা আছে দেখলাম:

নওজওয়ান জাড উঠদে নে
তান নিজাম বদল জান্দে নে,
ভগৎ সিং আজ্জ ভি প্যাদা হুন্দে নে,
বাস্ নাম বদল জান্দে নে...

[নওজোয়ান জাগে যখন,
রাজমুকুট মাটি হারায়।
আজও পয়দা হয় ভগৎ সিং
নামটুকু শুধু বদলে যায়...]

PHOTO • Vishav Bharti
PHOTO • Vishav Bharti

বাঁদিকে: শহীদ অজয় কুমারের বাড়ির ফটকে একটি কালো স্তম্ভে তাঁর প্রতিকৃতিটি রয়েছে। ডানদিকে: রামগড় সর্দারন গাঁয়ের একটি হোর্ডিংয়ে জ্বলজ্বল করছে উপরোক্ত কবিতাটি

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে জম্মু ও কাশ্মীরে আত্মাহুতি দেন অজয় কুমার। অজয়ের ছোটোবেলা থেকেই মাতামহ হাবিলদার পিয়ারা লাল তাঁকে অনুপ্রাণিত করে এসেছেন, দাদুর মতো তিনিও চাইতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। “মাধ্যমিক পাশ করেই তোড়জোড় নেওয়া শুরু করে আমার ছেলে,” বাবা চরণজিৎ সিং জানাচ্ছেন।

তারপর আরও বললেন, “নিয়োগের সময় ও অগ্নিবীর আর সেনার মধ্যে ফারাকটা জানত না।” তবে আজ তাঁর শাহাদতের পর কেবল শহীদ অজয়ের পরিবারই নয়, এমনকি আশপাশের গ্রামের উঠতি প্রজন্মের সন্তানেরাও 'ঠিকে সেপাই'-এর অর্থ জানে।

“আমার সঙ্গে এতটাই বাজে ব্যাপার হয়েছে যে সেটা দেখে জোয়ান ছেলেমেয়েরা দমে যাবে,” অঞ্জলি দেবী (২২) জানালেন, অজয় কুমারের ছ'বোনের মধ্যে ইনিই কনিষ্ঠতম। “ওরা জানবে যে শাহাদত রাখার পরেও অগ্নিবীরের বাড়ির সেসকল সুযোগ-সুবিধে পায় না যেগুলো আর পাঁচজন সেপাইদের দেওয়া হয়।”

রাগে-দুঃখে জ্বলেপুড়ে মরছেন অঞ্জলি দেবী, ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে, “ব্যাটারা অগ্নিবীরদের ঢাল বানিয়েছে, কারণ একজন অগ্নিবীর জান খোয়ালেও সরকারের কোনও দায় থাকে না। ওদের জীবনগুলো যেন এতটাই মাগনা।”

এ রাজ্যে ব্রিটিশদের সময় থেকে চলে আসছে ছেলেপুলেদের সেনাবাহিনীতে পাঠানোর বিরাসত, আর আজ অগ্নিবীরদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হচ্ছে যে সৈন্য হতে চাওয়া প্রার্থীরা ক্রমেই মুষড়ে পড়ছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ খতম হয়েছে আজ ১০৬ বছর আগে — ১৯১৮ সালে। সে মহাসমরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির প্রতি দুজন সেপাইয়ের একজন ছিলেন তৎকালীন পঞ্জাব প্রদেশের — অধুনা পঞ্জাব, হরিয়ানা ও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম পঞ্জাব মিলিয়ে। ১৯২৯ সালে সেনাবাহিনীর ১,৩৯,০০০ জনের ৮৬,০০০ জন ছিলেন জাতিতে পঞ্জাবি।

কয়েক বছর আগ পর্যন্তও সে চিত্রটা পাল্টায়নি। ১৫ মার্চ ২০২১ তারিখে সংসদে কিছু তথ্য পেশ করে সুরক্ষা মন্ত্রক, তাতে দেখা যায় যে ৮৯,০০০ জন প্রার্থী পাঠিয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে পঞ্জাব [প্রথম স্থানে উত্তরপ্রদেশ ছিল ঠিকই, তবে সে রাজ্যের জনসংখ্যা পঞ্জাবের সাড়ে সাতগুণ]। মোটে ২.৩ শতাংশ ভারতীয় পঞ্জাবে থাকেন, অথচ আর্মিতে পঞ্জাবিদের সংখ্যা ৭.৭ শতাংশ। অথচ জনসংখ্যার নিরিখে ইউপির ভাগ ১৬.৫ শতাংশ হয়েও সেনাবাহিনীতে তার অবদান কেবল ১৪.৫ শতাংশ।

PHOTO • Courtesy: Surinder Singh

২০২২ সালের এই আলোকচিত্রে সারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঙ্গরুর জেলার ফিজিক্যাল আকাদেমি লেহরাগাগার সেনাপ্রার্থীরা। দু'বছর আগে অগ্নিবীর যোজনা শুরু হলে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়

তবে হ্যাঁ, অগ্নিবীর যোজনা জারি হওয়ার পর থেকে ছবিটা তৃণমূল স্তরে পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এককালে গোটা রাজ্য জুড়েই সেনা নিয়োগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেখা যেত, সে ছোটো শহর হোক বা বড়ো শহরে। কিন্তু সেনাপ্রার্থীর সংখ্যা আচমকা তলিয়ে যেতেই গত দুই বছরে সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রর অধিকাংশই আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

সাঙ্গরুর জেলার লেহরাগাগা শহরে প্রায় এক দশক ধরে 'ফিজিক্যাল আকাদেমি' নামক একটি সেনা নিয়োগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালাতেন সুরিন্দর সিং, আজ সেটিরও চিরতরে ঝাঁপ পড়ে গিয়েছে। তিনি আমাদের বললেন যে প্রতিবছর পাতিয়ালা, সাঙ্গরুর, বার্নালা, ফতেহগড় সাহিব আর মানসা জেলা থেকে হাজার হাজার যুবক-যুবতী তাঁর কেন্দ্রে তালিম নিতে আসত একাধিক ব্যাচে। তবে অগ্নিবীর যোজনা চালু হতেই কাঙ্খিত প্রার্থীদের থেকে আসা অনুসন্ধানের সংখ্যাটা একধাক্কায় পঞ্চাশে এসে ঠেকে। “খরচাপাতিটুকুও কুলোচ্ছিল না, তাই বাধ্য হলাম বন্ধ করে দিতে,” একরাশ আক্ষেপ নিয়ে জানালেন তিনি।

২০১১-এ চালু হয়ে ২০২২ সালেই ঝাঁপ ফেলে দেয় সুরিন্দর সিংয়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি, তার মাঝে, “আমাদের হাতে তালিম নেওয়া প্রায় ১,৪০০-১,৫০০ জন নওজোয়ান ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।”

সুরিন্দর সিং এটাও জানালেন যে পঞ্জাব, রাজস্থান ও হরিয়ানার সবকটা শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রর হালত একই। তাঁর কথায়, “আনুমানিক ৮০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে।” বাদবাকি ২০ শতাংশ চালু থাকলেও তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ পুলিশ আর আধাসামরিক বাহিনীতে নিয়োগের জন্য তালিম দিচ্ছে।

“আগে যেখানে গাঁ-পিছু পঞ্চাশ কি একশোটা উঠতি ছেলেপিলে সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিতে চাইত, আজ সেটা কমতে কমতে দুই থেকে পাঁচে এসে ঠেকেছে। অগ্নিবীর যোজনার প্রভাব এতটাই ব্যাপক।”

পাতিয়ালা জেলার নাভা শহরে নিউ সৈনিক পাবলিক আকাদেমি চালাতেন করমজিৎ সিং। তিনি বললেন, ২০২৩ সালে ৬০ জন পড়ুয়া সশস্ত্র বাহিনীর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু নয়া এ যোজনার মারপ্যাঁচ পরিষ্কার হতেই দেখা যায় যে তাদের মধ্যে থেকে কেবল হাতে-গোনা ক'জন দৈহিক প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে। শেষমেশ আকাদেমির পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হন করমজিৎ সিং।

PHOTO • Courtesy: Surinder Singh
PHOTO • Courtesy: Surinder Singh

বিগত দুই বছরে সাঙ্গরুরের এই সেনাপ্রার্থী তালিম কেন্দ্রটির মতন অসংখ্য ট্রেনিং সেন্টারের ঝাঁপ পড়ে গিয়েছে চিরকালের মতো, কারণ সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক প্রার্থীর সংখ্যা হঠাৎ করে পড়ে গেছে

তেমনই একজন পড়ুয়া সাঙ্গরুর জেলার আলিপুর খালসা গ্রামের জগসির গর্গ, তিনিও লিখিত পরীক্ষা পাশ করা সত্ত্বেও আর শারীরিক পরীক্ষা দিতে যাননি। কারণটা কী জানেন? “মা-বাবা বলেছিল, মোটে চার বছরের একটা কাজের জন্য জীবনের ঝুঁকি নেওয়া বেকার। দুর্ঘটনা ঘটলে বাড়ির লোক ফুটোকড়িও পাবে না। আকাদেমিতে আমার ব্যাচের অনেকেই লিখিত পরীক্ষা পাশ করেও ফিজিক্যাল টেস্ট আর দিতে যায়নি,” তিনি বললেন। জগসির আজ পুরোনো মোটরসাইকেল বেচা-কেনার কারবার করেন।

বাড়ির ছেলেমেয়েদের সশস্ত্র বাহিনীতে পাঠানোর পরম্পরা এ রাজ্যে বহুযুগের, তাই পঞ্জাবের ছোটোবড়ো প্রতিটা শহরে নিয়োগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এমন ছড়াছড়ি ছিল। আজ তাদের সিংহভাগ লাটে উঠেছে, কিংবা রূপান্তরিত হয়েছে পুলিশ নিয়োগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে — সুরিন্দর সিং ঠিক যেমনটা বললেন। প্রথম আঘাতটা আসে মার্চ ২০২০ থেকে মার্চ ২০২২-এর মাঝে, যখন সেনাবাহিনীতে নিয়োগ রদ হয়ে যায়। কারণটা মূলত ছিল কোভিড, এবং তার ঠিক পরপরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল।

এরপর একদিন বিস্তর মাথা খাটিয়ে অগ্নিপথ প্রকল্প বার করে আমাদের সরকার বাহাদুর। ১৪ জুন ২০২২, কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের এটির গায়ে 'আকর্ষক' কর্মনিয়োগ যোজনার তকমা সেঁটে ঘোষণা করে। আগে যেখানে তরুণ-তরুণীদের রেগুলার ক্যাডেটের পদে ন্যূনতম ১৫ বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে নেওয়া হত, তার বদলে এই যোজনার আওতায় তাদের কেবলমাত্র চার বছরের জন্য হবে।

সরকারের লম্বা-চওড়া বুকনি, এ যোজনা নাকি এতটাই মহান যে এতে “সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি খাতেরই মানবসম্পদ নীতিতে নতুন যুগ আসবে।” ২০২০ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীতে বাৎসরিক গড় নিয়োগ সংখ্যা ছিল প্রায় ৬১,০০০; অগ্নিপথ যোজনার খাতিরে এ সংখ্যাটা এসে দাঁড়াবে ৪৬ হাজারে — আগের বিভিন্ন প্রতিবেদনে পারি'র সাংবাদিকরা ঠিক এমনটাই উল্লেখ করেছেন।

আরও কী জানেন? গ্রামীণ যুবসমাজের কাছে আর্মিতে আজীবন দেশসেবা করার যে স্বপ্নটা ছিল, সেটা বেঘোরে মারা যায়। এবার থেকে তারা মোটে চার-বছরের চুক্তিতে সৈন্যদলে নিযুক্ত হবে, মেয়াদের শেষে তাদের মোটে এক-চতুরাংশ সুযোগ পাবে আর্মির বাঁধা ক্যাডার হওয়ার।

পাতিয়ালার পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিফেন্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রাক্তন প্রধান ড. উমরাও সিংয়ের মতে গ্রামীণ সমাজের চোখে সশস্ত্র বাহিনীর ইজ্জত অনেকখানি তো বটেই, সেটা ছাড়াও পঞ্জাবিদের কাছে অনুকূল কর্মসংস্থান পরিস্থিতি ছিল আর্মিতে যোগ দেওয়ার প্রধান প্রেরণা।

PHOTO • Courtesy: Surinder Singh
PHOTO • Courtesy: Surinder Singh

বাড়ির সন্তানদের সশস্ত্র বাহিনীতে পাঠানোর রেওয়াজ পঞ্জাবে বহুকালের, তাই এখানকার ছোটোবড়ো সকল শহরেই নিয়োগপ্রার্থী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দেখা মিলত বরাবর

“অগ্নিবীর যোজনা বলবৎ হওয়ার পর মানুষের কাছে এ চাকরির সম্মান একধাক্কায় অনেকখানি পড়ে গেছে। লোকের কাছে এঁরা ঠেকে কা ফৌজি, অর্থাৎ ঠিকে সেপাই নামে পরিচিত। ইজ্জতের ভাগশেষ হ্রাস পাওয়ায় প্রার্থীসংখ্যাও ব্যাপক হারে তলিয়ে গেছে। অগ্নিবীর চালু হতেই নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা একলাফে বিশাল পরিমাণে বেড়েছে। কিন্তু কানাডার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় এখন সে রাস্তাটাও বন্ধ। ইতিমধ্যেই কৃষিসংকটে নাজেহাল পঞ্জাবের গ্রামীণ সমাজ আজ আসন্ন ভরাডুবির দিন গুনছে,” বলছেন ড. উমরাও সিং।

নিয়োগপ্রার্থীর সিংহভাগ হয় কৃষিবাড়ির কিংবা ভূমিহীন দলিত পরিবারের সন্তান। ঠিক সেই কথাটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন মানসা জেলার রংরিয়ল গাঁয়ের ইয়াদবিন্দর সিং — সেনাবাহিনীর লিখিত পরীক্ষার জন্য ইনি প্রার্থীদের তালিম দেন। “যে যে পরিবারের কাছে পাঁচ-সাত একর জমিজমা আছে, এমনকি সেবাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যেও বিরাট উৎসাহ ছিল, অথচ আজকাল কৃষিসমাজ থেকে উঠে আসা নিয়োগপ্রার্থী দেখাই যায় না প্রায়। আজ মূলত দলিত পরিবারের সন্তানরাই উৎসাহ দেখাচ্ছে, কারণ তাদের যে আর কোনও উপায় নেই।”

তেমনই একটি ভূমিহীন দলিত পরিবারের ছেলে ছিলেন শহীদ অজয় কুমার। “খোয়াবটাকে বাস্তব বানাতে ছেলেটা আমার বহু বছর ধরে দিনমজুরি খেটেছে, ওর মা তো এটাসেটা নানান কাজ করত — ভূমিদারের গোয়ালঘর সাফ থেকে মনরেগার কামকাজ,” অজয়ের পিতা চরণজিৎ সিং জানাচ্ছেন, “কিন্তু বিনিময়ে আমরা কী পেলাম বলুন তো? পয়সাকড়ি? সেটা তো দেখতে দেখতেই গায়েব হয়ে যাবে।” [চরণজিৎ সিং জীবনবিমার কথা বলছেন, কারণ অগ্নিবীর হওয়ায় ক্ষতিপূরণ বাবদ একটা আধুলিও অজয় কুমার পাওয়ার যোগ্য নন]।

মানুষটা তো চলে গেছে, কিন্তু পড়ে আছে কী? চরণজিৎ সিং তা ইঙ্গিত করে দেখালেন: সযত্নে রাখা একটি কালোরংয়ের আর্মি তোরঙ্গ, তাতে বাঁকানো সাদা অক্ষরে লেখা আছে 'অগ্নিবীর অজয় কুমার'। তিনটি শব্দে কেবল অজয়ের নয়, বরং পঞ্জাবি যুবসমাজের আস্ত একটি প্রজন্মের ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া খোয়াবনামা ধরা আছে।

PHOTO • Vishav Bharti
PHOTO • Vishav Bharti

বাঁদিকে: অগ্নিবীর অজয় কুমারের ভিটেয়, তাঁর পোর্ট্রেট। ডানদিকে: ২৫তম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল গৌরব ঋষির পাঠানো শোকবার্তা, অজয় কুমার এই সেনাবিভাগেরই অংশ ছিলেন

PHOTO • Vishav Bharti
PHOTO • Vishav Bharti

বাঁদিকে: শহীদ অজয় কুমারের কামরায় রাখা আছে তাঁর তোরঙ্গটি। ডানদিকে: তাঁর মা-বাবা মঞ্জিৎ কৌর এবং চরণজিৎ সিং, তাঁদের পিছনের ওই ফ্লেক্সবোর্ডটিতে লেখা আছে মাতৃভূমি ও আত্মত্যাগ নিয়ে দু'ছত্র কবিতা (নিচে দেখুন)

শহীদ অজয় কুমারের ভিটেয় সদ্য নির্মিত একটি কামরায় যেন বড্ড তাড়াতাড়িই অতীতের সঙ্গে বর্তমান মিশে গিয়েছে। মা-বাবার একমাত্র পুত্রসন্তান, দু'জন আইবুড়ো আর চারজন বিবাহিত বোনের একমাত্র ভাই — ঘরময় সাজানো তাঁর স্মৃতিচিহ্ন: পাট করে রাখা উর্দি, সযত্নে রক্ষিত পাগড়ি, পালিশ করা বুটজুতো আর ফ্রেমে বাঁধাই করা কিছু ছবি।

আমাদের কথোপকথনের মাঝে মাঝে যতিচিহ্নের মতো গাঁথা ছিল যন্ত্রণাময় নিস্তব্ধতা। শহীদ অজয় কুমারের বাবাকে একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারলাম না: উনি কি এতকিছুর পরেও গাঁয়ের বাদবাকি ছেলেদের সেনাদলে যোগ দেওয়ার উপদেশ দেবেন? “অমনটা আর কেনই বা করব? আমার ছেলেটা তো অকারণে সব ছেড়েছুড়ে চলে গেল। বাকিদের কোল এমন বেঘোরে কেন খালি হবে?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

তাঁর ঠিক পিছনের দেওয়ালে একটি ফ্লেক্স ঝুলছে, সেখান থেকে নিঃশব্দে ভেসে এল শহীদ অজয় কুমারের স্বর:

লিখ দিও লহু নাল অমর কাহানি, ওয়তন দি খাতির
কর্ দিও কুরবান এহ্ জওয়ানি, ওয়তন দি খাতির

[টকটকে লাল রক্ত দিয়েই অমরকাহিনি লেখ, দেশের দশের তরে
যৌবনকাল জীবন-মরণ কুরবানি দিস তোরা, দেশের দশের তরে...]

স্মৃতির মাঝদরিয়ায় টালমাটাল চরণজিৎ সিংয়ের দুটি চোখে যেন শুধু একটাই সওয়াল: সে কুরবানির বিনিময়ে স্বর্গাদপি গরীয়সী মাতৃভূমি কীই বা দেবে তাঁদের?

পুনশ্চ:

২৪ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে, তেরঙ্গা জড়ানো আরও এক শহীদের দেহ পৌঁছল পঞ্জাবের মানসা জেলার এক ক্ষুদ্র চাষির ঘরে তাঁর নাম লাভপ্রীত সিং, বয়স মোটে ২৪ এই মুলুকের সীমান্ত রক্ষা করতে গিয়ে গত ১৫ মাসে এই নিয়ে তিনজন অগ্নিবীর শাহাদত রাখলেন

তিনজনই প্রাণ হারিয়েছেন কাশ্মীরে প্রথমজন ছিলেন অগ্নিবীর অমৃতপাল সিং, যিনি শহীদ হয়েছিলেন ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে তারপর, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে সেই অজয় কুমারের পালা, এই প্রতিবেদনটি যাঁকে ঘিরে শহীদ অজয়ের মতন লাভপ্রীতের বাবা বিয়ন্ত সিংও কেবল স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন

" লাভপ্রীতের কেনা একখানা নতুন হাতঘড়ি বাড়িতে ডেলিভারি দিয়ে গেছিল; ছেলেটার খুব সাধ ছিল ঘরে ফিরে ঘড়িটা পরবে কিন্তু সেটা আর হল না," সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বিয়ন্ত সিং আরও একটি পরিবারে চিরতরে থমকে গেল সময় একে একে খসে যাচ্ছে তরতাজা প্রাণ, তারই সঙ্গে অগ্নিবীরদের ইজ্জত আর বিচারের দাবিতে দিনকে দিন আরও বেশি করে ফেটে পড়ছে পঞ্জাব

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Vishav Bharti

Vishav Bharti is a journalist based in Chandigarh who has been covering Punjab’s agrarian crisis and resistance movements for the past two decades.

Other stories by Vishav Bharti
Editor : P. Sainath
psainath@gmail.com

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Translator : Joshua Bodhinetra
bodhinetra@gmail.com

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra