নব কুমার মাইতির কারখানার চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে হাঁসের পালক। আছে পরিষ্কার পালক, নোংরা পালক, ছেঁটে-ফেলা পালক, বিভিন্ন আকারের এবং নানা মাত্রায় সাদা রং-এর পালক। খোলা জানালা থেকে ঢুকে পড়া নরম হাওয়ায় কিছুটা এলোমেলো হয়ে গিয়ে উড়তে থাকে পালকগুলো। তারপর নেমে আসে আবার।
উলুবেড়িয়ায় নব কুমারবাবুর তেতলা বাড়ির একতলায় আছি আমরা। কারখানার ভেতরে শুধু ছোটো কাঁচি আর বড়ো লোহার কাটাই যন্ত্রের শব্দ। এখানে তৈরি হচ্ছে ভারতবর্ষের ব্যাডমিন্টন খেলার শাট্লকক। “সাদা হাঁসের পালক, সিন্থেটিক আর ন্যাচারাল কর্ক, নাইলন-কটন মিক্স সুতো আর আঠা নিয়ে তৈরি করা যায় শাট্লকক,” চালানে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত একটা পিপে থেকে একটা শাট্ল বের করে বললেন নব কুমারবাবু।
২০২৩ সালের অগস্ট মাসের শেষের দিকে এক সোমবার। বেশ কড়া রোদ আর দিনটাও গুমোট। ঘড়িতে সকাল আটটা। আমরা তখনও জানি না যে পাঁচ সপ্তাহ পরেই ভারতীয় খেলোয়াড়রা প্রথমবার এশিয়ান গেমসে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২১-১৮; ২১-১৬-এ হারিয়ে দিয়ে সোনা জিতবে।
উলুবেড়িয়ার কারখানার সামনে এখন সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারিগরদের সাইকেল আর চটি। গায়ে একটা ফুল-হাতা মেরুন রঙের ইস্তিরি করা শার্ট চাপিয়ে আর কেতাদুরস্ত প্যান্ট পরে নব কুমারবাবুও দিন শুরু করার জন্য প্রস্তুত।
“আমি বারো বছর বয়সে হাঁসের পালক দিয়ে ব্যাডমিন্টন বল বানানো শুরু করি, বাণীবনে, আমার গ্রামের একটা কারখানায়,” বললেন ৬১ বছর বয়সি নব কুমারবাবু। এই পথে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন পালককে সঠিক আকার দেওয়ার কাজ দিয়ে। হাতে-ধরা লোহার কাঁচি দিয়ে তিন ইঞ্চির পালককে তার নির্দিষ্ট আকার দিতেন তিনি। কারিগররা শাট্লকে বলেন ‘বল’।
“প্রথম ফ্যাক্টরি [বাংলায়] ছিল পীরপুরে জে বোস এন্ড কোম্পানি। একশো বছর আগে। তারপর জে বোসের কারিগররা নিজেদের ইউনিট খুলতে শুরু করল। ওরকম একটা ইউনিটে আমি কাজ শিখেছি,” যোগ করলেন তিনি।


হাওড়া জেলার যদুরবেড়িয়া অঞ্চলে নব কুমারদার একটা শাট্লকক বানানোর কারখানা আছে। তিন ইঞ্চিতে আটকানো লোহার বড়ো কাঁচি দিয়ে পালক ছেঁটে দেখাচ্ছেন নব কুমারবাবু। সাদা হাঁসের পালক, কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক কর্ক, নাইলন-কটন মিক্স সুতো আর আঠা দিয়ে তৈরি হয় শাট্লকক
১৯৮৬ সালে উলুবেড়িয়ার বাণীবন গ্রামের হাটতলায় নিজের কারখানা শুরু করেন নব কুমার মাইতি এবং ১৯৯৭ সালে যদুরবেড়িয়ায় নতুন কারখানা আর বাড়ি বানিয়ে উঠে আসেন। এখানেই এখন তাঁর কাজ এবং বসবাস। এই কারখানায় তিনি উৎপাদনের তদারকি করেন, কাঁচামালের জোগানের দেখাশোনা এবং বিক্রিবাটার দিকটাও তিনিই দেখেন। এছাড়া পালক বাছার কাজও করেন নব কুমারবাবু।
বানীবন জগদীশপুর, বৃন্দাবনপুর, উত্তর পীরপুর এবং বাণীবন সেন্সাস টাউন, উলুবেড়িয়া পুরসভা এবং হাওড়া জেলার বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে (২০১১ আদমসুমারি) প্রধান তিনটি উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে শাট্লকক।
“২০০০-এর প্রথম দিকে উলুবেড়িয়াতে ১০০টা মতো ইউনিট ছিল। এখন হয়তো ৫০টা আছে। তার মধ্যে আমার কারখানার মতো ১০–১২ জন কারিগর আছে হয়তো ১০টা কারখানায়,” বললেন নব কুমারবাবু।
*****
নব কুমারবাবুর কারখানার সামনে রয়েছে একটা সিমেন্টের বাঁধানো উঠোন। তাতে একটা টেপা কল, উনান, আর মাটিতে গাঁথা দুটো হাঁড়ি। “এই জায়গাটা পালক ধোওয়ার জন্য। এখান থেকেই কাজটা শুরু হয়,” তিনি জানাচ্ছেন।
এই কারখানার এক কারিগর রঞ্জিত মণ্ডল ১০,০০০টা হাঁসের পালক প্রস্তুত করছেন। ৩২ বছর বয়সি রঞ্জিতবাবু বুঝিয়ে বললেন, “পালকের সাপ্লায়ারদের ব্যবসা উত্তরবঙ্গের কুচবিহার, মুর্শিদাবাদ আর মালদায়। কিছু লোকাল ব্যবসায়ী আছে, কিন্তু তাদের দাম আরো অনেক বেশি।” পনের বছর এখানে কাজ করছেন রঞ্জিতবাবু। বর্তমানে তিনি উৎপাদন তদারকির দায়িত্বে আছেন।
১০০০টার বান্ডিলে বিক্রি হয় পালক। দাম তাদের মানের ওপর নির্ভরশীল। “এখন সবথেকে ভালো পালকের দাম ১২০০ টাকা। মানে, একেকটার দাম এক টাকা কুড়ি পয়সা,” হাঁড়িতে উষ্ণ গরম জলে ভেজানো কিছু পালক ধোয়ার জন্য হাতে তুলে নিয়ে বললেন রঞ্জিতবাবু।

রঞ্জিত মণ্ডল সাদা হাঁসের পালক ধুচ্ছেন। এটাই শাট্লকক বানানোর প্রথম ধাপ


উষ্ণ গরম সাবান জলে পালক পরিষ্কার করেন রঞ্জিতবাবু। ‘পালক একদম ধবধবে সাদা হতে হবে,’ তিনি বলেন। ছাদের ওপর এই কারিগর একটা কালো ত্রিপলের ওপর সমান ভাবে বিছিয়ে দিচ্ছেন পালক। শুকিয়ে গেলে এগুলো থেকেই শাট্লকক তৈরি হবে
একটা মাঝারি মাপের ডেকচিতে জলের সঙ্গে সার্ফ এক্সেলের গুঁড়ো মিশিয়ে সেটাকে জ্বালানি কাঠের উনুনের ওপর বসিয়ে দেন রঞ্জিতবাবু। তাঁর কথায়, “পালক একদম ধবধবে সাদা হতে হবে। গরম সাবান জলে ধুলে সব ময়লা চলে যায়। কিন্তু অনেক দিন রেখে দিলে পচে যেতে শুরু করবে।”
পালকগুলো ভালো করে পরিষ্কার করার পর একটা হেলানো বাঁশের ঝুড়িতে একটার ওপর আরেকটা পালক থরেথরে সুন্দর করে সাজান তিনি। এখান থেকে সাবান জল পুরোটা ঝরে যাবে। তারপর আরেকবার জলে ধুয়ে উঠোনের অন্য হাঁড়িটাতে শেষবারের মতো ভিজিয়ে রাখা হবে পালকগুলোকে। “পালক ধুতে ঘণ্টা দুয়েক লেগে যায়,” ১০,০০০টা পালক ঝুড়িতে করে শুকোতে দেওয়ার জন্য ছাদে নিয়ে যেতে যেতে জানালেন রঞ্জিতবাবু।
তিনি আরও জানালেন, “বেশিরভাগ পালক আসে মাংসের জন্য যেসব হাঁস কাটা হয় তাদের থেকে আর হাঁসের ফার্ম থেকে। কিন্তু গ্রামের দিকে অনেক বাড়িতে পোষা হাঁসের পালক পড়ে গেলে সেগুলো কুড়িয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে।”
ছাদের ওপর একটা কালো রঙের ত্রিপল পেতে চারিদিকে ইটের টুকরো দিয়ে চাপা দেন রঞ্জিতবাবু যাতে সেটা উড়ে না যায়। তারপর পালকগুলো ত্রিপলের ওপর সমান ভাবে বিছিয়ে দিয়ে বলেন, “আজ ভালোই রোদ আছে। এক ঘণ্টায় পালকগুলো শুকিয়ে যাবে। তারপর সেগুলো দিয়ে ব্যাডমিন্টন বল বানানো হবে।”
পালকগুলো শুকিয়ে যাওয়ার পর একটা একটা করে সমস্ত পালক খুঁটিয়ে দেখা হয়। “হাঁসের পালকের ছয় রকমের গ্রেড আছে – এক থেকে ছয়। পালকগুলোকে সেই অনুযায়ী বাছতে হয়। হাঁসের কোন ডানার পালক – বাঁদিক না ডানদিক – সেটাও দেখতে হয়। এক দিক থেকে পাঁচ-ছটা পালক কাজে লাগানো যায়,” বললেন রঞ্জিতবাবু।
“একটা শাট্লে ১৬টা পালক থাকে। সেগুলো একই ডানার হওয়া চাই। সমস্ত পালকের মূল অক্ষের (শ্যাফট) জোর, অক্ষের দুইদিকের তন্তুর (ভেন) বেধ, আর ঢাল (কার্ভেচর) একই রকম হতে হবে,” নব কুমারবাবু জানালেন। “নইলে হাওয়ায় গোঁত্তা খাবে।”
“সাধারণ লোকের কাছে সব পালকই এক রকম দেখতে। কিন্তু আমরা ছুঁয়েই বলে দিতে পারি কোনটা আলাদা,” তাঁর সংযোজন।


বাঁদিকে: শংকর বেরা এক থেকে ছয় গ্রেড অনুযায়ী পালক বেছে বেছে রাখছেন। সমস্ত পালকের মূল অক্ষের (শ্যাফট) জোর, অক্ষের দুইদিকের তন্তুর (ভেন) বেধ, আর ঢাল (কার্ভেচর) একই রকম হতে হবে। ডানদিকে: সঞ্জীব বোদক দুটি শাট্ল ধরে আছেন। বাঁহাতের শাট্লে হাঁসের বাঁদিকের ডানার পালক এবং ডান হাতের শাট্লে হাঁসের ডানদিকের ডানার পালক ব্যবহার করা হয়েছে
এখানে তৈরি শাট্লকক কলকাতার স্থানীয় ব্যাডমিন্টন ক্লাবে এবং পশ্চিমবঙ্গ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড আর পন্ডিচেরির পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছেই মূলত বিক্রি হয়। “বড়ো ম্যাচের জন্য জাপানি কোম্পানি ইয়োনেক্স বাজার দখল করে রেখেছে। ওরা রাজহাঁসের পালক ব্যবহার করে। আমরা ওই স্তরের প্রতিযোগিতায় পারি না,” বলছেন নব কুমারবাবু। “আমাদের শাট্ল ছোটোখাটো খেলায় ব্যবহার করা হয় আর নতুন খেলোয়াড়রা প্র্যাক্টিসের জন্য ব্যবহার করে।”
চিন, হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান এবং ব্রিটেন থেকে শাট্লকক আমদানি করে ভারত। ভারত সরকারের অধীন বাণিজ্য বিষয়ক তথ্য এবং পরিসংখ্যান মহানির্দেশালয় (ডাইরেক্টরেট জেনারেল অফ কমার্শিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্স)-এর একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১২২ কোটি টাকার শাট্লকক আমদানি করেছে ভারতবর্ষ। “ব্যাডমিন্টন যেহেতু ঘরের মধ্যে খেলা হয়, তাই শীতকালে বলের চাহিদা বাড়ে,” বলছেন নব কুমারবাবু। তাঁর কারখানায় সারাবছরই শাট্ল বানানো হয়, কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস থেকে উৎপাদন অনেকটা বেড়ে যায়।
*****
মাদুর পাতা মেঝের ওপর বাবু হয়ে বসে কাজ করছেন কারিগরেরা। উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপের কাজ করছেন ঝুঁকে পড়ে। তাঁদের দক্ষ আঙুল এবং স্থির দৃষ্টি একমত্র তখনই একটু থমকে যায় যখন হাওয়ার দমকায় এলোমেলো হয়ে যায় পালক – যেগুলো শাট্লককে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ার কোনও একটা ধাপে রয়েছে।
রোজ সকালে নবকুমারের স্ত্রী, ৫১ বছর বয়সি কৃষ্ণা মাইতি, পুজো করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন কারখানায়। নিঃশব্দে মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে হাতে একটা ধূপকাঠি নিয়ে দুটো ঘর ঘুরে নেন। সকালের বাতাস ভরে ওঠে ফুলের সুবাসে।
ঘরের ভেতর কাজ শুরু হয় ৬৩ বছরের শংকর বেরার হাতে। এই কারখানায় তিনি গত এক বছর হল কাজ করছেন। একেকটা পালক নিয়ে লোহার বড়ো কাঁচির মধ্যে ঢোকান তিনি। তিন ইঞ্চির ব্যবধানে কাঁচিটি আটকানো। “ছয় থেকে দশ ইঞ্চি লম্বা পালকগুলো সমান মাপে কাটা হয়,” বললেন শংকরবাবু।


বাঁদিকে: কারিগররা যে কাজ করছেন তার জন্য বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। ডানদিকে: ‘ছয় থেকে দশ ইঞ্চি লম্বা পালকগুলো সমান মাপে কাটা হয়,’ বললেন শংকর বেরা
একটা ছোটো প্লাস্টিকের ঝুড়িতে পালক কেটে রাখতে রাখতে শংকরবাবু বুঝিয়ে বললেন, “পালকের শ্যাফটের (মূল অক্ষ) মাঝখানের অংশটা সবথেকে শক্ত। সেটা ছাঁটা হয়। এরকম ১৬টা অংশ দিয়ে একটা শাটল তৈরি হয়।” ছেঁটে-ফেলা পালকের ঝুড়ি তিনি দিয়ে দেবেন চারজন কারিগরকে যাঁরা দ্বিতীয় ধাপের কাজ করবেন।
তিন ইঞ্চির পালকগুলোকে সঠিক আকার দেওয়াটা হল পরের ধাপের কাজ যেটা প্রহ্লাদ পাল, ৩৫, মন্টু পার্থ, ৪২, ভবানী অধিকারী, ৬০ এবং লিখন মাঝি, ৬০ – এই চারজন মিলে করেন। কোলের ওপর রাখা কাঠের বারকোশে পালকগুলো রাখেন তাঁরা।
পালকের মূল অক্ষের তলার অংশটা পুরো পরিষ্কার করা হয় আর ওপরের অংশটার এক দিক ঢাল রেখে আর অন্য দিকে সোজা করে কাটা হয়,” কাজটা করতে করতে বললেন প্রহ্লাদবাবু, হাতে একটা লোহার কাঁচি। একটা পালক ডিজাইন করতে সময় লাগল ছয় সেকেন্ড। পালক কাটা আর তাকে আকার দেওয়ার কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের আয় প্রতি ১০০০ পালক পিছু ১৫৫ টাকা – অর্থাৎ একেকটা শাট্লককের জন্য ২ টাকা ৪৫ পয়সা।
“পালকের কোনও ওজন নেই বটে, কিন্তু মূল অক্ষ বা দাঁড়াটা শক্তপোক্ত। প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর কাঁচিগুলোকে শান দেওয়ার জন্য এখানকার কামারের কাছে পাঠাতে হয়,” বললেন নব কুমারবাবু।


বাঁদিকে: ছাঁটা পালকগুলোকে আকার দেওয়ার জন্য কারিগরদের কাছে চালান করা হয়। ডানদিকে: প্রহ্লাদ পাল হাতে-ধরা লোহার কাঁচি দিয়ে পালকগুলো কেটে সঠিক আকার দেন


মন্টু পার্থ (বাঁদিকে) এবং তাঁর সঙ্গে ভবানী অধিকারী ও লিখন মাঝি (ডানদিকে) ছাঁটা পালকগুলোকে সঠিক আকার দেন
ইতিমধ্যে সঞ্জীব বোদক, ৪৭, রেডিমেড গোলার্ধ আকৃতির কর্কের ভিতে ছিদ্র করছেন। এটাই এই গোটা প্রক্রিয়ার একমাত্র হাতে-চালানো মেশিন। হাতের স্থিরতা এবং নির্ভুল দৃষ্টির ওপর নির্ভর করে সমদূরত্বে ১৬টা ছিদ্র ড্রিল করে তৈরি করবেন তিনি। কর্ক পিছু পাবেন তিন টাকা ২০ পয়সা।
“দুই ধরনের কর্ক বেস হয়। মীরাট আর জলন্ধর থেকে আমরা আনাই সিন্থেটিক বেস আর চিন থেকে ন্যাচারাল বেস। ভালো পালকের জন্য প্রাকৃতিক কর্ক ব্যবহার করা হয়, বললেন সঞ্জীববাবু। দাম থেকেই মান বোঝা যায়। “সিন্থেটিক কর্কের দাম এক টাকা। আর ন্যাচারাল কর্কের দাম ৫ টাকা,” সংযোজন সঞ্জীববাবুর।
কর্কের বেস-র ড্রিল করা হয়ে গেলে পালক-সহ সেগুলো দেওয়া হবে ৫২ বছর বয়সি তাপস পন্ডিত এবং ৬০ বছর বয়সি শ্যামসুন্দর ঘরোইকে। তাঁরা এই ছিদ্রের মধ্যে পালক ঢোকানোর কাজ করেন যা হল এই প্রক্রিয়াটিতে সব থেকে সম্মানের কাজ।
পালকের ওপর দিকটা ধরে তলার দিকে প্রাকৃতিক আঠা লাগান তাঁরা। তারপর এক এক করে ছিদ্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। “শাট্ল বানানোর প্রতিটা ধাপের একটা বিজ্ঞান আছে। যদি কোনও ধাপে ভুল হয়, তাহলে শাট্লের ফ্লাইট (উড়ান), রোটেশন (আবর্তন), আর ডিরেকশন (দিশা) ভুলভাল হয়ে যাবে,” বুঝিয়ে বললেন নব কুমারবাবু।
“একটা বিশেষ অ্যাঙ্গেলে পালকগুলো একটার ওপর আরেকটা চাপানো থাকবে। এই কাজ একটা শন্না দিয়ে করা হয়,” কাজটা করতে করতেই বললেন তাপসবাবু। তিরিশ বছর ধরে এই জ্ঞানে শান দিয়ে নিখুঁত করেছেন তিনি। তাঁর এবং শ্যামসুন্দরবাবুর রোজগার নির্ভর করে কতগুলো পিপে ভরতে পারেন তার ওপর। একেকটা পিপেতে থাকে ১০টা করে শাট্ল। কাজেই একটা ব্যারেল ভরতে পারলে আয় হয় ১৫ টাকা।


বাঁদিকে: ড্রিলিং মেশিনটা এই প্রক্রিয়ার একমাত্র হাতে-চালানো যন্ত্র। সঞ্জীববাবু এটা দিয়ে কর্কে বেসে ১৬টি ছিদ্র করেন। ডানদিকে: সাদা কর্ক বেসগুলো কৃত্রিম এবং হালকা বাদামি কর্ক বেসগুলো প্রাকৃতিক


পালকের ওপর দিকটা ধরে তলার দিকে গদের আঠা লাগান গ্রাফটিং বিশেষজ্ঞ তাপস পন্ডিত। তারপর শন্নার সাহায্যে এক এক করে ছিদ্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন, একটার পিঠে আরেকটাকে চাপিয়ে
পালকগুলো কর্কে আটকানো হয়ে গেলে প্রাথমিক ভাবে একটা শাট্লের আকার ধারণ করে। এর পর সুতোর কাজের জন্য সেগুলো দেওয়া হয় ৪২ বছর বয়সি তারখ কয়ালকে। “সুতোগুলো এই অঞ্চল থেকেই কেনা। নাইলন আর কটনের মিশ্রণে সুতোগুলো আরো শক্ত হয়,” বললেন তারখবাবু। তাঁর এক হাতে একটা দশ-ইঞ্চি সুতো জড়ানো আর অন্য হাতে কর্ক আর পালক।
১৬টা পালক একটা অন্যটার ওপর চাপানো – প্রাথমিক ভাবে সুতোতে বাঁধতে ৩৫ সেকেন্ড লাগে তাঁর। “সুতোটা একেকটা পালকের মূল অক্ষ গিঁট দিয়ে ধরে রাখে, তারপর দুটো অক্ষ বা দাঁড়ার মাঝখানে দুবার গেরো দিতে হয়,” বললেন তারখবাবু।
এত দ্রুত কবজি নড়ে তারখবাবুর, প্রায় দেখাই যায় না। শেষ গিঁটটা পাকানোর পরই দেখা যায় ১৬টা গিঁট আর ৩২টা গেরো। শেষ গিঁটটা বেঁধে তিনি কাঁচি দিয়ে অতিরিক্ত সুতোটা কেটে দেন। শাট্ল পিছু তিনি পান ১১ টাকা।
শেষবারের মতো পালকের বিন্যাস এবং সুতোর অবস্থান খুঁটিয়ে দেখে নেন ৫০ বছর বয়সি প্রবাস শাসমল। প্রয়োজনমতো ঠিক করে নিয়ে পিপের পর পিপে শাট্ল কক দিয়ে ভরাট করে চালান করে দেন সঞ্জীববাবুকে। তিনি এবার শাট্লের শক্তি বাড়ানোর জন্য তার গায়ে লাগান কৃত্রিম আঠা (রেসিন) আর ঘনত্ব বর্ধক (হার্ডনার)।


বাঁদিকে: পালকগুলো কর্কে আটকানো হয়ে গেলে প্রাথমিক ভাবে একটা শাট্লের আকার ধারণ করে। তারখ কয়াল তারপর পালকগুলোকে একবার গিঁট আর দু’বার গেরো দিয়ে বেঁধে ফেলেন। ডানদিকে: প্রবাস শাসমল পালকের বিন্যাস এবং সুতোর অবস্থান খুঁটিয়ে দেখে নেন

প্রতিটা শাট্লের বেড়-এ (রিম) ব্র্যান্ডের নাম সেঁটে দেন সঞ্জীববাবু
শুকিয়ে যাওয়ার পর শাট্ল তৈরি শেষ ধাপের জন্য – ব্র্যান্ডিং। সঞ্জীববাবু বললেন, “একটা আড়াই ইঞ্চির নীল ফিতের ওপর ব্র্যান্ডের নাম লেখা থাকে। সেটা কর্কের চারিদিকে লাগানো হয়। আর পালকের দাঁড়ের তলায় একটা স্টিকার লাগিয়ে দিই। তারপর একেকটা শাট্লকক ওজন করে মাপ অনুযায়ী একেকটা পিপেতে ভরা হয়।”
*****
অগস্ট মাসে পারি’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নব কুমারবাবু বলেছিলেন, “আমাদের তিনটে অলিম্পিক মেডেল আছে – সাইনা নেহওয়াল আর পি ভি সিন্ধু জিতেছেন। ব্যাডমিন্টন খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু উলুবেড়িয়াতে অল্পবয়সিরা যদি পালক নিয়ে ফ্লাইট তৈরি করতে শেখেও, খেলোয়াড়দের মতো তাদের ভবিষ্যৎ যে নিশ্চিত হবে, এমন কোনও কথা নেই।”
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডাইরেক্টোরেট অফ মাইক্রো, স্মল এবং মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ উলুবেড়িয়া পুরসভাকে একটি শাট্লকক বানানোর ক্লাস্টার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু নব কুমারবাবু বলছেন, “ক্লাস্টার হওয়ার পরেও এখানে কোনও পরিবর্তন হয়নি। সব দেখনদারি। আমাদের নিজেদেরটা নিজেদেরই দেখতে হচ্ছে।”
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে পালক দিয়ে শাট্ল তৈরির ব্যবসাকে এমন এক চালের সম্মুখীন হতে হয় যাকে নেটের ওপারে ফেরত পাঠানো অসম্ভব। বিশ্ব ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন খেলার সমস্ত স্তরে সিন্থেটিক শাট্লের ব্যবহারকে স্বীকৃতি দেয়। কারণ এই ধরনের শাট্ল বেশি টেকসই, “অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এগিয়ে আছে, ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদি।” এর পরে ব্যাডমিন্টনের আইনের ২.১ ধারায় এর অন্তর্ভুক্তি হয় – “শাট্ল তৈরি হবে প্রাকৃতিক এবং/অথবা সিন্থেটিক পদার্থ দিয়ে।”


বাঁদিকে: শাট্লের পিপেতে ব্র্যান্ডের নাম সাঁটেন রঞ্জিতবাবু এবং সঞ্জীববাবু। ডানদিকে: ওজন করার পর একেকটা পিপেতে ১০টা করে শাট্ল ঢুকিয়ে দেন রঞ্জিতবাবু
“নাইলন বা প্লাস্টিক বুঝি পালকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবে? খেলার কী হবে আমি জানি না, কিন্তু যখন গোটা বিশ্বে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আমরা কতদিন টিকে থাকতে পারব বলে মনে হয়?” প্রশ্ন নব কুমারবাবুর। “কৃত্রিম শাট্ল বানানোর প্রযুক্তি বা দক্ষতা – কোনওটাই আমাদের নেই।”
“আজ প্রায় সমস্ত কারিগরই মধ্যবয়স্ক বা প্রবীণ নাগরিক। তাঁদের রয়েছে ৩০ বা আরও বেশি বছরের অভিজ্ঞতা। কিন্তু নতুন প্রজন্ম এটাকে আর জীবিকা হিসেবে দেখছে না,” বললেন তিনি। একদিকে নামমাত্র মজুরি, অন্যদিকে পালকের এই সূক্ষ্ম কাজ শিখতে লাগেও অনেক সময়। তাই নতুন প্রজন্ম আর এই কাজে আসতে চায় না।
“সরকার যদি পালকের জোগানকে সহজ না করে, পালকের দাম বেধে না দেয়, আর আধুনিক মেশিন প্রযুক্তির ব্যবস্থা না করে দেয় তাহলে এই শিল্প আর কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ লোপ পাবে,” জানিয়ে দিলেন নব কুমারবাবু।
অদ্রীশ মাইতিকে তাঁর অমূল্য সাহায্যের জন্য প্রতিবেদক সহৃদয় ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
প্রতিবেদনটি মৃণালিনী মুখার্জী ফাউন্ডেশন (এমএমএফ) প্রদত্ত একটি ফেলোশিপের সহায়তায় লিখিত।
অনুবাদ: সর্বজয়া ভট্টাচার্য